menu 2

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Tuesday, March 21, 2017

নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ রচিত ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা’ অনূদিত বাংলা সংস্করণ – একটি পর্যালোচনা.......

নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ রচিত ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা’ অনূদিত বাংলা সংস্করণ – একটি পর্যালোচনা.......
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক //.
নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ গত শতাব্দীর একজন ব্যাপক আলোচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সংকলিত বিশাল গ্রন্থ ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ হাদিস বিশারদদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। স্বভাবতই এ নিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরও আগ্রহ কম নয়। ফতওয়া বিভাগগুলোতে এ বিষয়ে মানুষের বহু প্রশ্ন এসে থাকে। এমনি একটি প্রশ্ন এবং বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে কিছুটা বিস্তারিতভাবে এর জবাব পেশ করা হল।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আলোচ্য বিষয়টি মূলত গবেষণামূলক ইলমী আলোচনা হওয়ায় প্রয়োজনের খাতিরেই লেখাটিতে ব্যাপকভাবে পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। -সম্পাদক
......
প্রশ্ন:.........
বরাবর,
ফতওয়া বিভাগ মারকাযুদ্দাওয়া আলইসলামিয়া ঢাকা......
৭৯/১এ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪....
বিষয়: ‘যয়ীফ ও জাল হাদিস সিরিজ’ কিতাব ও কিতাবের মূল লেখক সম্পর্কে ফতওয়া বিভাগের মন্তব্য লিখিতভাবে জানার প্রসঙ্গে।
জনাব,...
প্রথমে আমার সালাম গ্রহণ করবেন। ফতওয়া বিভাগের মাধ্যমে আপনার নিকট উক্ত বিষয় সম্পর্কে জানার আবেদন করছি।....
উল্লেখ্য, ATN বাংলা টিভির ইসলামী অনুষ্ঠানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কিতাবটির মূল লেখক সম্পর্কে খুব ভাল মন্তব্য করেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, উক্ত লেখক নাকি আহলে আরব তথা আরব ভূখণ্ডের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন এবং ৬০এর দশকে তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মুহাদ্দিস পদেও নাকি ছিলেন।
অতয়েব, মাওলানা সাঈদী সাহেবের তথ্যের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ার কারণে কিতাবের মূল লেখক সম্পর্কে সঠিক বিষয় জানানোর জন্য আবেদন করছি।
(সঙ্গে কিতাবটিও সংযুক্ত হল।)
আবেদনকারী: মুহাম্মাদ রাইহান ১২৪, চকবাজার, ঢাকা, ৩১/০৩/২০০৪ঈ.
উত্তর:......
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. (মৃত্যু ১৪২০হি.) একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ ইলমে হাদীসের খেদমতে ব্যয় করেছেন। মানুষের মধ্যে সহীহ এবং যয়ীফ হাদিসের পার্থক্য নির্ণীত হোক, এ ব্যাপারে তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং আল্লাহ চাহে তো এজন্য তিনি আখেরাতে উত্তম বদলা পাবেন। ولا نزكي علي الله احدا তথাপি তাঁর সমসাময়িক মুহাক্কিক ন্যায়নিষ্ঠ আহলে ইলমের দৃষ্টিতে তাঁর রচনা ও গবেষণা কর্মের যেসব বিচ্যুতি ধরা পড়েছে তা থেকে চোখ বন্ধ রাখাও সমীচীন নয়। যথা-
(১). শায়খ আলবানী রহ. উলূমুল হাদীসের জ্ঞান এ বিষয়ের কোন বিজ্ঞ পণ্ডিতের নিকট থেকে গ্রহণ করেননি।
শায়খ আলবানী রহ.এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যাপারে এ বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত যে, তিনি উলূমুল হাদীসের জ্ঞান এ বিষয়ের কোন বিজ্ঞ পণ্ডিতের নিকট থেকে গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে নিজের অধ্যয়নই তাঁর মূল নির্ভর। অথচ শাস্ত্রীয় ব্যাপারে সর্বজন স্বীকৃত একটি মূলনীতি, অভিজ্ঞতাও যার সাক্ষ্য প্রদান করে তা এই যে, যেকোনো শাস্ত্রে পরিপক্বতা অর্জনের জন্য সে শাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তিদের সহচার্য লাভ করা জরুরী। ব্যক্তিগত অধ্যয়নে জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে পারে কিন্তু শাস্ত্রীয় পরিপক্বতা কোন শাস্ত্রীয় পণ্ডিতের সহচার্য ছাড়া অর্জিত হওয়া বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব।
আমাদের জানা মতে হাদীস শাস্ত্রে আলবানী রহ.এর একজন মাত্র উস্তাদ আছেন। তাঁর কাছ থেকেও তিনি শুধু প্রথাগত ‘ইজাযত’ গ্রহণ করেছেন। তাঁর সহচার্য অবলম্বন করা, তাঁর নিকট থেকে শাস্ত্রীয় জ্ঞান লাভ করা, কোনটাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। (দেখুন: মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আজমী (মৃত্যু ১৪১২হি.) ‘আলআলবানী শুযূযুহু ওয়াআখতাউহু’ ১/৯; শায়খ মুহাম্মাদ আওওয়ামা, আসারুল হাদীসিশ শরীফ ফিখতিলাফিল আইম্মাতিল ফুকাহা ৪৭)
এজন্য উলূমুল হাদীসের একজন সচেতন ছাত্রের কাছেও –যার কোন শাস্ত্রজ্ঞের সহচার্য লাভ হয়েছে- আলবানী সাহেবের এই দুর্বলতার প্রভাব তাঁর রচনাবলীতে অনেক স্থানেই প্রকটভাবে অনুভূত হয়। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারি। অনেক দীর্ঘ সময় শায়খ আলবানী রহ.এর রচনাবলি অধ্যয়ণের সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁর রচনাবলীতে তথ্য ও উদ্ধৃতির প্রাচুর্য থাকলেও ইলমী গভীরতা কম বোধ হয়েছে। সূক্ষ্ম ও মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়াদিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর আলোচনা অগভীর সিদ্ধান্তে সমাপ্ত হয়। এ জাতীয় অনেক দৃষ্টান্ত মুহাক্কিকগণের লিখিত কিতাবসমূহে পাওয়া যাবে। এ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা-নিবন্ধে সে সবের উদ্ধৃতি সম্ভব নয়; এজন্য আরবী ভাষা জানেন এমন পাঠক আমার রচনাধীন الشيخ الاالباني وكتابه سلسلة الضعيفة (আশ্‌শায়খ আল-আলবানী ওয়া-কিতাবুহু সিলসিলাতুয যয়ীফা) অধ্যয়ন করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ এখানে কয়েকটি নমুনা পেশ করছি:
(ক) سكتوا عنه শব্দটি ‘জারহে মুবহাম’ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। উলূমুল হাদীস এবং ‘জারহে তাদীল’এর সাথে জানাশোনা আছে এমন একজন ছাত্রও এ বিষয়টি বোঝে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত গর্বের সাথে শব্দটি ‘জারহে মুফাসসার’ হওয়ার ঘোষণা দেন এবং এ ব্যাপারে এমন দলীল পেশ করেন যে, এতে শাস্ত্রজ্ঞদের ‘ইবারত’ বোঝার ব্যাপারে তাঁর অদক্ষতা ও দুর্বলতার একটি নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। (দেখুন সিলসিলাতুয যয়ীফা ১/৬৬২)
অথচ ‘জারহে মুব্‌হাম’, ‘জার্‌হে মুফাস্‌সার’ ও ‘জার্‌হে মুবারহান’-এর পার্থক্য নিরূপণে সক্ষম হওয়া শাস্ত্রের প্রাথমিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত।
(খ) ‘মুরসাল’এর পারিভাষিক ব্যবহার-সমূহের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারায় এমন একটি হাদীসকে মুরসাল আখ্যা দিয়ে তাকে ‘যয়ীফ’ সাব্যস্ত করেছেন যা ‘সহীহ’ ও ‘মামূলবিহী’ হওয়ার ব্যাপারে ‘খাইরুল কুরূন’ এবং পরবর্তী সময়ে সমগ্র উম্মাহর ইজমা রয়েছে। এ বিষয়ে শায়খ আলবানীর মত জানার জন্য দেখুন তাঁর কিতাব ‘ইরওয়াউল গালীল’ ১/১৫৮ এবং হাদীসটির ব্যাপারে সমগ্র উম্মতের অবস্থান জানার জন্য দেখুন ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ.এর কিতাব ‘আলইসতিযকার’ ৮/১০
(গ) কোন কোন ব্যক্তি এই নীতি পেশ করেছেন, কেউ কেউ বাস্তবে তা অনুসরণও করেছেন যে, روي বা এ জাতীয় ‘সিগায়ে মাজহুল’ যয়ীফ বর্ণনার ক্ষত্রে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু শায়খ আলবানী রহ. এ নীতির অর্থ এই নিয়েছেন যে, যিনিই কোন স্থানে ‘সিগায়ে মাজহুল’ ব্যবহার করেছেন তিনিই তা ‘যয়ীফ’ বোঝনোর জন্যই ব্যবহার করেছেন। এজন্য তিনি কিছু সহীহ হাদীসকে যয়ীফ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে এ প্রমাণ পেশ করেছেন যে, অমুক ইমাম হাদীসটি ‘সিগায়ে মাজহুল’ দ্বারা উল্লেখ করেছেন। অথচ এটি এমনই ত্রুটি যা একজন সচেতন ছাত্রের পক্ষেও মানানসই নয়। কেননা অসংখ্য সহীহ হাদীস এমন আছে যা বর্ণনা করার সময় কোন না কোন ইমাম বা মুহাদ্দিস ‘সিগায়ে মাজহুল’ ব্যবহার করেছেন। দেখুন আলবানী রহ.এর কিতাব ‘সালাতুত তারাবীহ’; মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আজমী রহ.এর ‘আলআলবানী শুযূযুহু ওয়াআখতাউহু’ ১/১৬-২০; শায়খ ইসমাঈল আনসারী রহ. রচিত ‘তাসহীহু হাদীসি সালাতিত তারাবীহ’ ২৩-২৪
এখানে কিছু নমুনা পেশ করা হল। অন্যথায় আমার কাছে আলবানী রহঃ এর এ জাতীয় অগভীর ও ত্রুটিপূর্ণ বক্তব্য ও মতামতের এক দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে, যা এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
তবে এ ব্যাপারে সাধারণ কথা হল, তিনি অনেক ক্ষেত্রে উসূলে হাদিসের বিষয়াদিতে شرح نخبه (শারহে নুখবা) ও الباعث الحثيث (আলবায়িসুল হাসিস) এবং ‘জারহ তাদীল’এর বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে ‘তাকরীবুত তাহযীব’এর উপর নির্ভর করাকেই যথেষ্ট মনে করেন এবং এতে তিনি কোন ধরণের দ্বিধাবোধ করেন বলে মনে হয় না। শাস্ত্রীয় তাহকীক ও গবেষণার ক্ষেত্রে এর চেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতি আর কি হতে পারে?
চিন্তা করুন, একটি হাদিসকে তার নিজের ভাষ্য অনুসারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারি, ইমাম আবু হাতেম রাযী, ইমাম ত্বহাবী, ইমাম ইবনে হিব্বান প্রমুখ ইমামগণ ‘সহীহ’ বলেছেন; কিন্তু তিনি হাদিসটিকে ‘যয়ীফ’ বলার ব্যাপারে যেন পণ করে বসেছেন। তার বক্তব্য হল হাদিসটির একজন বর্ণনাকারী হলেন শরীক বিন আব্দুল্লাহ আন্‌নাখয়ী। ‘তাকরিবুত তাহযীবে’ আছে তিনি سيء الحفظ এবং سيء الحفظ রাবীর হাদীসকে সহীহ বলা নিয়ম বহির্ভূত। আলবানী রহ. যেন ইমাম বুখারী রহ. সহ এ সকল হাদীস শাস্ত্রের প্রাণপুরুষদেরকে ‘শরহে নুখবা’ ও ‘তাকরীবুত তাহযীব’ পড়াচ্ছেন। তাঁদেরকে হাদীসশাস্ত্রের নিয়মনীতি শিখাচ্ছেন। বলা বাহুল্য হবে না যে, ‘জার্‌হ তাদীল’ ও উসূলুল হাদীস এবং ফিকহুল হাদীসের ব্যাপারে অগভীর জ্ঞানই এ ধরণের প্রগলভতার একমাত্র কারণ। দেখুন সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ২/৩৬২-৩৬৪
(২) . ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’ এর ব্যাপারে শায়খ আলবানী রহ. এর অনুসৃত নীতি
শায়খ আলবানী রহ. ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’এর ব্যাপারে তাঁর অনুসৃত নীতি আলোচ্য কিতাবের শুরুতে এভাবে উল্লেখ করেছেন-
ومما ينبغي أن يُذكر بهذه المناسبة أنني لا أقلد أحداً فيما أصدِرُه من الأحكام على تلك الأحاديث، وإنما أتَّبِع القواعد العلمية التي وضعها أهل الحديث، وجرَوا عليها في إصدار أحكامهم على الأحاديث من صحة أو ضعف
ج:١، ص:٤٢
الكتاب: سلسلة الأحاديث الضعيفة والموضوعة وأثرها السيئ في الأمة المؤلف: أبو عبد الرحمن محمد ناصر الدين، بن الحاج نوح بن نجاتي بن آدم، الأشقودري الألباني (المتوفى: 1420هـ) دار النشر: دار المعارف، الرياض - الممكلة العربية السعودية الطبعة: الأولى، 1412 هـ / 1992 م عدد الأجزاء: 14 [ترقيم الكتاب موافق للمطبوع]
অর্থাৎ, তিনি সহীহ-যয়ীফ নির্ণয়ের ব্যাপারে পূর্ববর্তী হাদিস বিশারদ ইমাম বা পরবর্তী হাফিযুল হাদিস গনের কারো অনুসরণ করেন না; বরং আইম্মায়ে হাদীস যে নীতমালার আলোকে হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন, তিনিও সেসবের অনুসরণ করবেন এবং সরাসরি ওই সব নীতির আলোকেই সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন।
প্রশ্ন হয় যদি হাদিস বিশারদ ইমামগণের নীতিমালা অনুসরণ করা বৈধ হয়, তবে সেই সব নীতির আলোকে গৃহীত তাদের সিদ্ধান্ত সমূহের তাকলীদ করা এমন কি দোষের ব্যাপার যে তা থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিতে হয়েছে? অথচ একথা বলাই বাহুল্য যে, যারা এই সব নীতি নির্ধারণ করেছেন, তারাই এর হাকীকত ও প্রয়োগের ব্যাপারে অধিকতর জ্ঞাত।
দ্বিতীয়ত, শায়খ আলবানী রহ. কি হাদিস শাস্ত্রে এই পরিমাণ পাণ্ডিত্য ও পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন, যার ভিত্তিতে আইম্মায়ে কিরামের সিদ্ধান্তসমূহকে পরিত্যাগ করে নিজস্ব বিচার বিবেচনা মোতাবেক সেই সব নীতিমালা প্রয়োগের অধিকার তাঁর জন্মেছে? শাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ইমাম –যাঁদের বক্তব্য ও বাস্তব প্রয়োগ থেকেই শাস্ত্রের কায়দাকানুন তৈরি হয়- তাঁদের গবেষণা ও সিদ্ধান্তসমূহের তোয়াক্কা নয়া করে তাদের ‘নিয়ম’ অনুসরণের ভাওতায় নিজস্ব বিভার-বিবেচনা প্রসূত স্বেচ্ছাচারী ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’এর ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, তাকে পূর্ববর্তী ইমামগণ এমন কি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের সাথেও মতানৈক্যে লিপ্ত হতে হয়েছে। সহীহ মুসলিমের প্রায় বিশ বা ততোধিক হাদীসকে তিনি যয়ীফ বলেছেন এবং সহীহ বুখারীর বেশ কিছু হাদীসকেও সরাসরি ‘যয়ীফ’ বা ‘মুনকার’ বলে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন সহীহ বুখারীর ২১১৪ ও ২৮৫৫ নং হাদীস। এ দুটি হাদীসকে ‘যয়ীফুল জামিয়িস্‌ সগীর’ ২৫৭৬ ও ৪৪৮৪ নম্বরে যয়ীফ বলেছেন। সহীহ মুসলিমের যেসব হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন, তার আলোচনা تنبيه المسلم إلي تعدي الألباني علي صحيح مسلم (তাম্বীহুল মুসলিমি ইলা তাআদ্দিল আলবানী আলা সহীহি মুসলিম)-এ বিদ্যমান রয়েছে। এতে শায়খ আলবানী রহ. এর সিদ্ধান্তের ভ্রান্তি বরং তার দালীলিক আলোচনা পাওয়া যাবে।
যখন এই দুই ইমাম এবং তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব দুটির ব্যাপারেই তাঁর অনুসৃত নীতি ও আচরণ এই, তখন অন্যদের ব্যাপারে তাঁর আচরিত নীতির কথা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, যে বিষয়টি এ প্রসঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হল, ‘উলূমুল হাদীসের; মাঝারি মানের একজন ছাত্রও জানে যে, হাদীসের সহীহ-যয়ীফ নির্ণয় করা হাদীস বর্ণনাকারী রাবীগণের অবস্থা ও অবস্থানের নিরিখে তাদের পর্যায় নির্ধারণ করা, এক কথায় ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’ ও ‘জারহ্‌-তাদীল’এর বহু বিষয় এমন রয়েছে যা খোদ হাদীস বিশারদ ইমামগণের মধ্যেও মতভেদপূর্ণ। প্রশ্ন হয়, এ জাতীয় ক্ষেত্রে শায়খ আলবানী কোন মত বা পথ অবলম্বন করবেন? এ প্রশ্নের স্পষ্ট কোন উত্তর তাঁর বক্তব্যে পাওয়া যায় নয়া। অথচ বিষয়টি অস্পষ্ট ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল না।
অপর দিকে তাঁর বাস্তব কর্মক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে কোন ন্যায়নিষ্ঠ পাঠকের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা এ জাতীয় একাধিক মতপূর্ণ নীতিমালাতে তিনি নির্দিষ্ট কোন অবস্থানে স্থির নন। কোথাও একমত অবলম্বন করেন, অন্যত্র অপর মত। যেমন ‘মাসতূর’-এর হাদীস হুজ্জত হবে কিনা; ইব্‌ন হিব্বানের ‘তাওসীক’ গ্রহণযোগ্য কিনা; হাদীসের ‘তাসহীহ’ দ্বারা রাবীর ‘তাওসীক’ হয় কিনা; ‘যিয়াদাতুস সিকাত’ গ্রহণযোগ্য কিনা ইত্যাদি বিষয়ে শায়খ আলবানী রহ. অনেক যায়গায় স্ববিরোধিতার জন্ম দিয়েছেন। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ রচিত التعريف بأوهام من قسم السنن إلي صحيح و ضعيف (আত্‌তারিফ বিআওহামি মান কসামাস সুনানা ইলা সহীহিউ ওয়া যয়ীফ) ১/২৫ এবং কিতাবের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আলোচনা।
চতুর্থত, হাদীসের ‘সহীহ-যয়ীফ’ নির্ণয়ের জন্য সর্ব প্রথম যে বিষয়গুলো জানতে হয় তার মধ্যে ‘জারহ-তাদীল’ তথা হাদীস বর্ণনাকারীদের সত্যবাদিতা, স্মৃতিশক্তি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করা অন্যতম এবং এরই ভিত্তিতে রাবীদের স্থান ও পর্যায় নির্ণীত হয়, যা ছাড়া হাদীসের সহীহ-যয়ীফ নির্ণয় করা কখনো সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, শায়খ আলবানী রহ. যখন হাদীসের সহীহ-যয়ীফ নির্ণয়ের ব্যাপারে কারো তাকলীদ না করার ঘোষণা দিয়েছেন তখন রাবীর জার্‌হ-তাদীলের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কি হবে? তিনি কি এক্ষেত্রে আইম্মায়ে হাদীসের তাকলীদ করবেন, নাকি জার্‌হ-তাদীলের নীতিমালার আলোকে হাজার বছর আগের রাবীদের সত্যবাদীতা, স্মৃতি শক্তি এবং এ ধরণের আরো হাজারো বিষয়ের যাচাই সরাসরি নিজেই করবেন। এরপর রাবীদের স্থান ও পর্যায় নিরূপণ করবেন? এ প্রশ্নটির স্পষ্ট কোন উত্তর তাঁর বক্তব্যে পাওয়া যায় না। তবে তাঁর বাস্তব কর্ম-ক্ষেত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি কার্যত ‘জারহ্‌-তাদীলের’ ব্যাপারে সাধারণত তাকলীদই করে থাকেন।
প্রশ্ন হয় রাবীর জার্‌হ-তাদীলের ব্যাপারে ইমামগণের তাকলীদ করা যাবে আর হাদীসের ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’এর ক্ষেত্রে তাঁদের তাকলীদ করা যাবে না- এই দ্বৈত নীতির যৌক্তিক কোন কারণ থাকতে পারে কি?
এছাড়া এখানে আরো আফসোসের ব্যাপার হল, শায়খ আলবানী রহ. রাবীদের জার্‌হ তাদীলের ব্যাপারে তাকলীদ করলেও সেটাকে যথাযথ তাকলীদ বলাও কঠিন। কেননা তিনি সাধারণত ‘আসমাউর রিজাল’ ও ‘জার্‌হ তাদীল’এর সংক্ষিপ্ত কিতাবাদির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত দিয়ে বসেন অথবা দুএকটি মাঝারি ধরণের কিতাবের ভিত্তিতেই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যান। বলা বাহুল্য, তাহকীক ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ জাতীয় অবস্থান নিঃসন্দেহে ছেলেমীপনা।
অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে যে, তিনি শুধু ‘তাকরীবুত তাহযীব’, ‘খুলাসা’ বা ‘মীযানুল ই’তিদাল’ ইত্যাদি কিতাবের উপর নির্ভর করেই কোন রাবীকে ‘মাজহুল’ বা ‘যয়ীফ’ আখ্যায়িত করেছেন এবং এরই ভিত্তিতে অনেক হাদীসকে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়েছেন অথচ তিনি যদি ‘জারহ-তাদীল’এর বিস্তারিত ও দীর্ঘ কিতাবসমূহের সাহায্য নিতেন তবে দেখতেন যে, এসব রাবী গ্রহণযোগ্য এবং তাদের বর্ণিত ওই সকল হাদীসও সহীহ এবং তিনি বুঝতে পারতেন যে, এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী ইমামগণের বক্তব্যই সঠিক।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকজন রাবীর কথা আলোচিত হল:
১. ‘আব্দুল্লাহ বিন যুগ্‌ব’
‘আব্দুল্লাহ বিন যুগ্‌ব’ এর ব্যাপারে মিশকাতের টীকায় (৩/১৫০০) শায়খ আলবানী রহ. লিখেছেন “তিনি মাজহুল”। দলীল হিসেবে বলেছেন, ‘খুলাসা’তে তাঁর ব্যাপারে জার্‌হ-তাদীলের ইমামগণের কারো বক্তব্য উদ্ধৃত হয়নি।
অথচ ‘খুলাসা’র মত সংক্ষিপ্ত কিতাব কেন, আসমাউর রিজালের দশ-বিশটি দীর্ঘ কিতাবেও যদি কারো ব্যাপারে আলোচনা না পাওয়া যায় এবং তার ব্যাপারে কারো সিদ্ধান্ত না পাওয়া যায় তবে তাকে ‘মাজহুল’ আখ্যা দেওয়ার অধিকার শায়খ আলবানী কেন অষ্টম শতাব্দীর হাফিয যাহাবী রহ.এর মত ব্যক্তিত্বেরও নেই। (লিসানুল মীযান ৯/৭৯, তরজমা নং ৮৮৭৭ দ্রষ্টব্য)
অথচ শায়খ আলবানী শুধু এই দলীলে যে, ‘খুলাসা’তে ‘আব্দুল্লাহ বিন যুগ্‌ব’এর ব্যাপারে কোন মন্তব্য বিদ্যমান নেই, তাকে মাজহুল আখ্যা দিচ্ছেন। খোদার বান্দা যদি ‘খুলাসা’র সাথে আরো দুএকটি কিতাবের পাতা ওল্টানো পর্যন্তও ধৈর্য ধরতেন তবুও না হয় একটা কথা হত।
আফসোসের ব্যাপার হল, ‘আব্দুল্লাহ বিন যুগ্‌ব’ সাধারণ কোন রাবী নন, তিনি রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ছিলেন। فرضى الله عنه وعن جميع الصحابة أجمعين তাঁর ব্যাপারে আলোচনা তারাজিমুস সাহাবা (সাহাবীগণের জীবন-চরিত অভিধান) বিষয়ক কিতাবাদিতে বিদ্যমান রয়েছে। দেখুন, আল ইসাবা ৪/৯৫, ‘উসদুল গাবাহ ২/৬০০।
শায়খ আলবানী রহ. যদি অন্তত ‘তাহযীবুত তাহযীব’ (৫/২১৮) বা ‘তাকরীবুত তাহযীব’ (৩৬০) পড়ে নিতেন তবুও এই মারাত্মক ভ্রান্তিতে নিপতিত হতেন না।
২. ‘ইয়াহইয়া বিন মালিক আলআযদী আবু আইয়ূব আলমারাগী’
তিনি একজন তাবেয়ী এবং সহীহ মুসলিমের একজন রাবী। নাসায়ী, ইব্‌ন হিব্বান, ইজলী, ইব্‌ন সা'দ প্রমুখ তাকে ‘সিকা’ বলেছেন। কিন্তু শায়খ আলবানী রহ. মিশকাতের টীকায় (১/৪৩৮) একটি সনদের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন, “ইয়াহ্‌ইয়া ইবন্‌ মালিক আলআযদী ছাড়া সনদের সকল রাবী ‘সিকা’।”
ইয়াহ্‌ইয়া ইবন্‌ মালিক কেন ‘সিকা’ নন? এর উত্তরে তিনি বলেন, “তার ব্যাপারে ‘কিতাবুল জার্‌হ ওয়াত তাদীল’ (৪২/১৯০)এ কোন মন্তব্য উল্লেখ নেই।” ব্যাস এক কিতাবেই তাহকীক শেষ হয়ে গেল। অথচ তিনি ‘তাহযীবুত তাহযীব’ ও ‘তাকরীবুত তাহযীব’ ইত্যাদি কিতাবেও তার আলোচনা পড়ে নিতেন তবে এই তাবেয়ীকে অন্যান্য ‘সিকা রাবী’ থেকে বিচ্ছিন্ন করতেন না।
৩. ‘সাঈদ বিন আশওয়া’
শায়খ আলবানী রহ. إروإء الغليل (ইরওয়াউল গলীল) কিতাবে (৩/১২১) সাঈদ বিন আশওয়া এর ব্যাপারে বলেন, “আমি তার তরজমা বা আলোচনা পাইনি”। অথচ তাঁর আলোচনা ‘তাহযীবুত তাহযীব’ (৪/৬৭), ‘তাকরীবুত তাহযীব'’ (২৮৫) ছাড়াও আরো কিতাবেই রয়েছে। তাছাড়া তিনি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মত প্রসিদ্ধ কিতাব দুটির রাবী। তাঁর পুরো নাম সাঈদ বিন আমর বিন আশওয়া।
মোটকথা এ এক লম্বা ফিরিস্তি। এক দুই কিতাবের দুচার পৃষ্ঠা উল্টিয়েই কোন ‘সিকা’ বা ‘মারূফ’ রাবীকে, ‘যয়ীফ’ বা ‘মাজহুল’ বলে দেওয়া; তেমনি এক দুই কিতাব থেকে কোন ইমামের সিদ্ধান্ত অপূর্ণভাবে উল্লেখ করে, রাবীর ব্যাপারে ভুল মন্তব্য করা বা যথাযথভাবে রাবীর আলোচনা তালাশ না করেই 'তার আলোচনা পেলাম না' বলে দেওয়া ইত্যাদির বহু দৃষ্টান্ত শায়খ আলবানীর রচনাবলীতে পাওয়া যায়।
লজ্জার ব্যাপার হল, যখন তাঁকে এসব বিষয়ে সতর্ক করা হল তখন তাঁর অতিভক্ত লোকেরা তাঁর পক্ষ থেকে এই ওযর পেশ করল যে, “শায়খের 'নাশাত' হয়নি।” (অর্থাৎ, অনেক কিতাব থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি তাহকীক করতে তাঁর তবীয়তে চায়নি।) এজন্য তিনি ‘তাকরীবুত তাহযীব’এর উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন। দেখুন, আলী আল হালাবী রচিত إحكام المبانى (ইহ্‌কামুল মাবানী) ৩৬, ৪১, ৭৬।
এই ওযরখাহি থেকে এছাড়া আর কি অর্থ বের হয় যে, শায়খ আলবানী রহ. তাহকীক করা ছাড়াই তাঁর ‘তবীয়তসম্মত’ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন; যদিও সিদ্ধান্তটি পূর্ববর্তী ইমামগণের বিরোধীই হোক না কেন। লড়াই হবে ফন ও শাস্ত্রের ইমামগণের সাথে আর হাতিয়ার হবে ‘তাকরীবুত তাহযীব’ বা তারও পরের কোন কিতাব! কী অদ্ভুত ব্যাপার!
৩. শায়খ আলবানীর স্ববিরোধিতা
হাদীসের ‘তাসহীহ-তাযয়ীফ’, রাবীর ‘জারহ্‌-তাদীল’ এবং শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর স্ববিরোধীতার বিষয়টিও অবহেলা করার মত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে যে, একস্থানে একই হাদীসকে ‘সহীহ’ বা ‘হাসান’ বলে বসেছেন। কোথাও কোন রাবীকে ‘সিকা’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন, আবার অন্যত্র তাকেই যয়ীফ বা অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। একাধিক মতসমৃদ্ধ নীতিমালা ও ক্ষেত্রসমূহে কখনো একটি মতসমৃদ্ধ নীতিমালা ও ক্ষেত্রসমূহে কখনো একটি মত অবলম্বন করেছেন, আবার কখনো অন্য মত।
তাঁর এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্তসমূহের কিছু এমন হয়ে থাকবে যাতে তাঁর মত পরিবর্তিত হয়েছে। কোন হাদীস বা রাবীর ব্যাপারে পূর্বে তাঁর ধারণা এক রকম ছিল; পরে তাতে পরিবর্তন এসেছে। এ জাতীয় বিষয়াদিকে শায়খ আবুল হাসান মুহাম্মাদ তাঁর تراجع العلامة الألبانى فيما نص عليه تصحيحا وتضعيفا কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এতে সর্বমোট ২২২টি হাদীস স্থান পেয়েছে।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এমনও রয়েছে যেখানে তাঁর এই স্ববিরোধিতা মত পরিবর্তনের কারণে নয়; বিস্মৃতি বা অবহেলার কারণে হয়েছে। এছাড়া কিছু স্থান এমনও আছে যেখানে তাঁর বক্তব্যের পূর্বাপর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই স্ববিরোধিতার পিছনে আসাবিয়্যাত তথা পক্ষপ্রবণতার প্রভাব রয়েছে; যদিও তিনি নিজেকে আসাবিয়্যাতের ঘোর বিরোধী হিসেবে প্রকাশ করে থাকেন এবং প্রায়ই ন্যায়নিষ্ঠ আলেমগণের প্রতি আসাবিয়্যাতের অপবাদ আরোপ করতেও তাঁকে দেখা যায়।
শায়খ হাসান সাক্কাফ রচিত تناقضات الألبانى الواضحات (আলবানীর সুস্পষ্ট স্ববিরোধীতাসমূহ) আমরা কিতাবটির আকণ্ঠ সমর্থক নই এবং তাঁর উপস্থাপনার সাথেও একমত নই, তবে তাঁর অতিরঞ্জন গুলো বাদ দিয়ে যদি শায়খ আলবানীর স্ববিরোধীতা গুলোও আলোচনা করা হয় যা অন্যান্য ন্যায়নিষ্ঠ আহলে ইলমের আলোচনাতেও রয়েছে, তবে তার সংখ্যা কম হবে না, প্রচুর।
৪. ইজতেহাদী বিষয়াদিতে অসহিষ্ণুতা
এ বিষয়টি শাস্ত্রজ্ঞ ইমামগণের কাছে ঐক্যমত্যপূর্ণভাবে স্বীকৃত যে, হাদীস ভাণ্ডারে বিদ্যমান হাদীসসমূহের ‘সহীহ’ বা ‘যয়ীফ’ হওয়া বিবেচনায় তিন ভাগে বিভক্ত। যথা:
1.যেসব হাদীস সহীহ হওয়ার ব্যাপারে সকল ইমাম একমত হয়েছেন।
2.যেসব বর্ণনা ‘যয়ীফ’ বা ‘মাতরূক’ (পরিত্যাজ্য) হওয়ার ব্যাপারে সকল ইমাম একমত হয়েছেন।
3.যা ‘সহীহ’ বা ‘যয়ীফ’ হওয়ার ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।
বাস্তবতার নিরিখেও হাদীসের এই প্রকার তিনটি সুস্পষ্ট। এর মধ্যে প্রথম দুই প্রকার হাদীসের বিষয়টি সহজ ও পরিষ্কার। কিন্তু শায়খ আলবানী রহ. তাঁর ‘সিলসিলাতুল আহাদীস’কে এই (প্রথম) দুই প্রকারে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি যথারীতি শেষোক্ত হাদীসও প্রচুর পরিমাণে উল্লেখ করেছেন।
এ তৃতীয় প্রকারের হাদীসের ব্যাপারে শাস্ত্র ও বিবেকের সিদ্ধান্ত হল, ‘আহ্‌লে ফন’ বা শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি তাহকীক ও গবেষণার ভিত্তিতে যে সঠিক বা বিশুদ্ধ মনে করবেন, তিনি সেই মতকে অবলম্বন করবেন। আর যারা এই শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ নন তারা কোন শাস্ত্রজ্ঞের তাকলীদ বা অনুসরণ করবেন। তবে অনুসরণের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে মতটি যেন ‘পণ্ডিতের পদস্খলন’ না হয়।
ইমাম বাইহাকী (মৃত্যু ৪৫৮হি.) তাঁর "দালাইলুন নবুওয়্যাহ" কিতাবের ভূমিকায় এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন-
وأما النوع الثالث، من الأحاديث فهو حديث قد اختلف أهل العلم بالحديث في ثبوته: فمنهم من يضعفه بجرح ظهر له من بعض رواته خفى ذلك عن غيره، أو لم يقف من حاله على ما يوجب قبول خبره، وقد وقف عليه غيره، أو المعنى الذي يجرحه به لا يراه غيره جرحا، أو وقف على انقطاعه أو انقطاع بعض ألفاظه، أو إدراج بعض رواته قول رواته في متنه. أو دخول إسناد حديث في حديث خفى ذلك على غيره.
فهذا الذي يجب على أهل العلم بالحديث بعدهم أن ينظروا في اختلافهم، ويجتهدوا في معرفة [ (89) ] معانيهم في القبول والردّ، ثم يختاروا من أقاويلهم أصحّها. وبالله التوفيق.
উম্মাহর আলেমগণের কর্মনীতিও আজ পর্যন্ত এ-ই ছিল। এ প্রকারের হাদীসসমূহে বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য যেহেতু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই প্রত্যেকেই অপরের মতের প্রতি সহিষ্ণু রয়েছেন। যার বিচার-বিবেচনায় হাদীসটি সহীহ সাব্যস্ত হয়, তিনি মাসাআলার ভিত্তিরূপে হাদীসটিকে গ্রহণ করেন। আর যার বিচার বিবেচনায় হাদীসটি সহীহ সাব্যস্ত হয় না তিনি মাসাআলার ভিত্তি হিসেবে একে গ্রহণ করেন না। এ ক্ষেত্রে গ্রহণ-অগ্রহণ উভয়ই হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। আর এজন্যই প্রত্যেককে অপর মতের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল বা অন্তত সহিষ্ণু হতে হয়। আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণ এমনই ছিলেন।
এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, যিনি হাদীসটি গ্রহণ করেছেন আর যিনি গ্রহণ করেননি, তিনিও এজন্যই গ্রহণ করেননি যে, তাঁর বিবেচনায় হাদীসটি সহীহ নয়। এখন কেউ যদি প্রথমোক্ত ব্যক্তির ব্যাপারে এই অভিযোগ দায়ের করে যে, তিনি যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করেন অথবা শেষোক্ত ব্যক্তিকে এই বলে অভিযুক্ত করে যে, তিনি সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করেন তাহলে এটা হবে নিছক একটি চাতুরীপূর্ন বক্তব্য। এ জাতীয় অবস্থান পরিহার করাই ইলমী শিষ্টাচারের দাবী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আলবানী রহ. ও তাঁর অন্ধভক্তদের পক্ষে তা পরিহার করা সম্ভব হয়নি।
আর এ জাতীয় ক্ষেত্রে নিজের মতকে চূড়ান্ত মনে করা বা যথাযথ দলীলভিত্তিক সমালোচনার ব্যাপারে অসহিষ্ণু হওয়া এবং সমালোচককে গালিগালাজ করা কিংবা নিজের সিদ্ধান্তকে অন্য সকলের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা পোষণ করা –এসবই যে অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং শরীয়তের রুচিপ্রকৃতি ও ইখতিলাফের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী তা তো বলাই বাহুল্য। অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হয়, শায়খ আলবানী রহ. ও তাঁর বিশিষ্ট ভক্ত-অনুরক্তদের পক্ষে উপরোক্ত নীতিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি। নিজের সিদ্ধান্তসমূহের ব্যাপারে খোদ শায়খ আলবানী রহ.এরই অতিরিক্ত সুধারণা ছিল। তাঁর রচনাবলী পাঠ করলে একজন সাধারণ পাঠকের মনে এ ধারণাই সৃষ্টি হয়। বিশেষত তাঁর রচনা صفة صلاة النبى صلى الله عليه وسلم التكبير إلي التسليم، كأنك تراها এর নামটিই লক্ষ করুন অথবা এর ভূমিকা পড়ুন কিংবা তাঁর অন্যান্য রচনা যথা غاية المرام في تخريج أحاديث الحلال والحرام এর ভূমিকা দেখুন। বিষয়টি একদম স্পষ্ট হয়ে যাবে। বরং তাঁর সেসব বক্তব্য থেকে এই ভাব প্রকাশ পায় যে, তিনি যেন তাঁর সিদ্ধান্তসমূহ মেনে নিতে মানুষকে বাধ্য করতে চাচ্ছেন! অথচ ইজতিহাদী বিষয়ে এই অবস্থান কখনো কাম্য নয়।
সিলসিলাতুয্‌ যয়ীফা, সিলসিলাতুস সহীহা বরং তাঁর অন্যান্য রচনার ভূমিকা পড়লে একজন নিরপেক্ষ পাঠকের মনে এ ধারণাই সৃষ্টি হয় যে, তাঁর সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হওয়াই একটি অমার্জনীয় অপরাধ এবং এই অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি তাঁর পক্ষ থেকে যেকোনো ধরণের সম্বোধনের উপযুক্ত হতে পারে।
শায়খ ইসমাঈল আনসারী রহ. যিনি প্রসিদ্ধ সালাফী আলেম এবং রিয়াদ কেন্দ্রীয় দারুল ইফ্‌তার একজন গবেষক ছিলেন তিনিও এই অপরাধে তাঁর পক্ষ থেকে ‘সুন্নাহ্‌র দুশমন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
উম্মাহ্‌র অন্যান্য মনিষী যারা তাঁর মাসলাক ও মাশরাবের সাথেও একমত নন, তাঁদের সাথে তাঁর আচরণ কেমন হবে তা তো বলাই বাহুল্য।
[আকমাল হোসাইন সাহেব এক হিসেবে ভালোই করেছেন যে, ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’র মুকাদ্দমা অনুবাদ করেননি। তার এ কাজটি যদিও অনুবাদনীতির পরিপন্থী; কিন্তু এতে অন্তত শায়খ আলবানীর ওই সব জবরদস্তিগুলো তো সাধারণ পাঠকদের কাছ থেকে গোপন থাকল! ]
এ পর্যায়ে এসে স্বভাবতই যে প্রশ্নটি উদ্রেক হয়, যিনি নিজেকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ইমামের সমালোচনা-পর্যালোচনার উপযুক্ত মনে করেন এবং তাঁদের সকলের রচনাবলীর উপর কর্তৃত্ব চালানোকে নিজের অধিকার জ্ঞান করেন তিনি অন্যের সমালোচনায় অস্থির হবেন কেন? সমালোচকের সমালোচনা ঠাণ্ডা মাথায় অনুধাবন করে যদি তা প্রত্যাখ্যানই করতে হয় তবে যথাযথ আদব ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথেও তো প্রত্যাখ্যান করা যায়। এজন্য কটু-বাক্যের আশ্রয় নেয়া তো কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
অপরদিকে এও তো বাস্তব সত্য যে, খোদ শায়খ আলবানী রহ.এর সমালোচনাগুলো অনেকটাই বিচারকসুলভ। এক্ষেত্রে বড় ছোটর তেমন কোন প্রভেদ তাঁর কাছে নেই।
তিনি ইমাম বুখারী রহ.এর ‘আলআদাবুল মুফরাদ’ কিতাবটিকেও দুই টুকরো করেছেন। তিনি যেন ইমাম বুখারী রহ.কেই শিখাচ্ছেন, ‘জনাব, এ কিতাবে এই হাদীসগুলো আনা সমীচীন হয়নি।’ এমনকি সহীহ বুখারীর কিছু হাদীসকেও তিনি যয়ীফ বলেছেন। সহীহ মুসলিমের অনেক হাদীসের ব্যাপারে ‘মুখতাসারু সহীহ মুসলিম লিল মুনযিরী’এর টীকায় আলোচনা করে তা যয়ীফ বা ‘মালূল’ সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসায়ী এঁদের প্রত্যেকের কিতাবকে দুই টুকরো করে ‘সহীহু আবী দাউদ’, ‘যয়ীফু আবী দাউদ’, ‘সহিহুত তিরমিযী’, ‘যয়ীফুত তিরমিযী’, ‘সহীহুন নাসায়ী’, ‘যয়ীফুন নাসায়ী’ তিন কিতাবকে ছয় কিতাব বানিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর এ কাজে কী কী ত্রুটি রয়েছে, এর কী মন্দ প্রভাব ইলমী ও আমলী ময়দানে পড়ছে এবং সালাফদের রচনাবলীর সাথে তাঁর মত ব্যক্তির জন্য এ ধরণের বিচারকসুলভ আচরণের কোন বৈধতা আছে কিনা? এসব বিষয়ে অন্য কোন অবসরে আলোচনা করা যাবে। এখানে শুধু এতটুকুই আরজ করতে চাই যে, উম্মাহর হাফিযুল হাদীস ও মহান ইমামগণের ব্যাপারে এমন দুঃসাহসিকতাপূর্ণ পথে সমালোচনা ও পর্যালোচনার পর অপারপর পর্যালোচকদের ব্যাপারে তাঁর এ আচরণ, যার প্রতি ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে কোনক্রমেই বোধগম্য নয়।
৫. যয়ীফ হাদীসের ব্যাপারে শায়খ আলবানীর অবস্থান
শায়খ আলবানী রহ. ‘যয়ীফ হাদীস’কে একদম অনর্থক মনে করেন। তাঁর মতে যয়ীফ হাদীসের কোন প্রকার কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি যয়ীফ ও মওযূ উভয়টাকে একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং উচ্চকণ্ঠে এ ঘোষণা দিয়েছেন যে, যয়ীফ সর্বক্ষেত্রেই পরিত্যাজ্য। এটা না ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, না মুস্তাহাব বিষয়াদির ক্ষেত্রে, অন্য কোন ক্ষেত্রে। -সহীহুল জামিইস সগীর ওয়া যিয়াদাতিহী, পৃ:১৫০
অথচ এ মতটি সলফ ও সলাফুস সলেহীনের ঐক্যমত্যপূর্ণ নীতিমালার বিরোধী। জমহুরে সলফ ও খলফের ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত্যের খেলাফ হওয়া তো অতি স্পষ্ট এবং সর্বজন বিদিত। বাস্তব কথা হল, তা সকল সলফ ও খলফের ইজমারই পরিপন্থী। এ ব্যাপারে কোন কোন মনিষী থেকে ভিন্নমত কোন কোন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে তা নির্দিষ্ট প্রকারের যয়ীফ হাদীসের ব্যাপারে অথবা যয়ীফ হাদীসের দ্বারা আহকাম বা বিধিবিধানের ক্ষেত্রে প্রমাণ গ্রহণ করার ব্যাপারে। যয়ীফ কোন কাজের নয় –এই মত যা শায়খ আলবানী অবলম্বন করেছেন, সলফ ও খল্‌ফের কেউ তা পোষণ করতেন না।
তাঁর এ মতটি ইমাম বুখারী রহ. তাঁর মাশায়েখ, সমসাময়িক ইমাম ও শিষ্যবৃন্দের এবং পূর্ববর্তী ইমামগণের ইজমায়ী মতকে দলীলহীন বা দলীলের পরিপন্থী বলা শুধু যে অন্যায় দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন তাই নয়, তা শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতারও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
এ বিষয়ে যয়ীফ হাদীস সংক্রান্ত আলোচনার প্রসিদ্ধ উৎসসমূহ ছাড়াও নিম্নোক্ত কিতাবসমূহ দেখা যেতে পারে-
ثلاث رسائل في استحباب المترات جمع الشيخ عبد الفتاح أبو غدة ١٠٠-١٠٤
حفر الأح للشيكه عبد الحي اللكوي بحائبة واستدرأكت الشيكه عبد الفتاح أبو غدة ١٨١-٢٠٦
الئقول السطيع للسحاوي بقلم الشيخ محمد عو امة حي ٤٢٢-٤٧٣
أثر الحديث الشريف للشيخ محمد عوامي ٣٢-٣٧
التعريف بأوهام من قسم السنن إلي صحيح و ضعيف للشيخ محمود سعد ممدوح
৬. ‘শুযূয’ তথা ইজমায়ে উম্মত থেকে বিচ্যুতি......
শায়খ আলবানী রহ.এর কাজকর্মের আরেকটি মৌলিক দিক হল, তাঁর আলোচনা-পর্যালোচনা শুধু হাদীসের তাসহীহ ও তাযয়ীফের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি তাঁর রচনাসমূহের বিভিন্ন স্থানে ফিক্‌হ, আকায়েদ ও অন্যান্য শাস্ত্রের বিভিন্ন বিশয়ে স্বাধীন বরং এক ধরণের বিচারকসুলভ পর্যালোচনা করতে থাকেন এবং এ ব্যাপারে তিনি এতটাই নিঃশঙ্কচিত্ত যে, বহু বিষয়ে ‘শুযূয’ (شذوذ) অবলম্বন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ ইজমায়ে উম্মত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে চলে আসা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মত পোষণ করা অথবা পূর্ববর্তী কোন মনিষীর ভ্রান্তি বা বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত কে পুনরায় জীবিত করা কোন ইলমী খেদমত নয়। ইলমী ক্ষেত্রে ‘শুযূয’ অবলম্বন করা হতে বিরত থাকার মধ্যেই একজন আলেমের আত্মমর্যাদা ও তাকওয়ার পরিচয়টি লুকায়িত থাকে।
এ জাতীয় মত ও পথ (শুযূয) অবলম্বন করা বা কোন মনিষীর ভ্রান্তির অনুসরণ করা যে অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ এ ব্যাপারে শরিয়তের প্রমাণাদি, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং পরবর্তী আসলাফে উম্মাহ্‌র সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য আহলে ইলমের অজানা নয়। এ প্রসঙ্গে ইবন্‌ আব্দুল বার রহ. (মৃ: ৪৬৩ হি.) এর جامع بيان العلم ২/১৩০ এবং ইবন্‌ রজব দামেস্কী রহ. (মৃ: ৭৯৫ হি.) এর شرح علل الترمذي বিশেষভাবে অধ্যয়নযোগ্য।
যেসব ভ্রান্তি বা বিচ্ছিন্ন মতের উদ্ভাবন কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা শায়খ আলবানী রহ. করেছেন তার কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে উদ্ধৃত হলঃ
১. তাঁর মতে মহিলাদের জন্য স্বর্ণের আংটি ও অন্যান্য ‘স্বর্ণবলয়’ ব্যবহার করা হারাম।
তাঁর মতে মহিলাদের জন্য স্বর্ণের আংটি ও অন্যান্য ‘স্বর্ণবলয়’ ব্যবহার করাকে হারাম। অথচ মহিলাদের জন্য যেকোনো ধরণের স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার করা তা বলয়াকৃতিরই হোক যেমন, গলার হার, লকেট ইত্যাদি বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উম্মাহ্‌র ইজমা প্রতিষ্ঠিত আছে এবং দলীল দ্বারাও তাই প্রমাণিত। চিন্তার বিষয় হল, বলয়াকৃতির অলঙ্কার আর বিছানো অলঙ্কারের মধ্যে এমন কি পার্থক্য যে, একটা হালাল হবে আর অপরটা হারাম হবে?
এ মাসাআলায় শায়খ আলবানী রহ.এর বিচ্ছিন্ন মতটির ভ্রান্তি প্রমাণ করার জন্য শায়খ ইসমাঈল আনসারী (সাবেক গবেষক, কেন্দ্রীয় দারুল ইফ্‌তা, রিয়াদ, সৌদি আরব) إباحة التحلي بالذهب المحلق للنساء নামে একটি স্বতন্ত্র কিতাবই রচনা করেছেন।
২. আট রাকাআত তারাবীহ সুন্নাত ও বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদ’আত আখ্যা দেয়া।
আট রাকাআত তারাবীহ সুন্নাত ও বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদ’আত আখ্যা দেয়া। অথচ বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদ’আত আখ্যা দেওয়া গর্হিত কাজ। আমার জানা মতে আরবে এই ভ্রান্ত বিদ’আতী মতবাদের সূচনা শায়খ আলবানীর আগে আর কেউ করেননি। ইংরেজ শাসনামলে কোন লা-মাযহাবী মৌলভী এই মতবাদের সূচনা করলে বিশিষ্ট লা-মাযহাবী আলেমরাই এর প্রতিবাদ করেন।
শায়খ আলবানী এই ‘শায’ মতটির ভ্রান্তি প্রমাণে লিখিত শায়খ ইসমাঈল আনসারী রহ. এবং শায়খ মুহাম্মাদ আলী সাবূনী (উস্তাদ, জামি’আ উম্মুল কুরা, মক্কা মুকার্‌রমা)এর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করাই যথেষ্ট হবে।
৩. তাঁর মতে এক মজলিসে তিন তালাক দেওয়া হলে তা এক তালাক গণ্য হবে।......
তাঁর মতে এক মজলিসে তিন তালাক দেওয়া হলে তা এক তালাক গণ্য হবে। (ইরওয়াউল গলীল ৭/১২২) অথচ এই মতটি সহীহ হাদীস ও ‘খাইরুল কুরূন’এর ইজমা পরিপন্থী। এ বিষয়ে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় দারুল ইফ্‌তা থেকে প্রকাশিত কিতাব مجلة البحوث الإسلامية (المجلد الأول، العدد الثالث سنة حكم الطلاق الثلاث-١٢٩٧) এ অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থে দেখা যেতে পারে। এতে উপরোক্ত বিচ্ছিন্ন মতটির বিপরীতে বহু হাদীস ও সহীহ আসার উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. নামাযের যে পদ্ধতি শায়খ আলবানী রহ. তাঁর কিতাব صفة الصلاة النبي صلي الله عليه و سلم এ উল্লেখ করেছেন একমাত্র একেই ‘নববী নামায’ আর হাদীস ও আসারের সুবিশাল ভাণ্ডারে নামাযের অন্য যেসব পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সবগুলোকেই বিদ’আতী নামায ও রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত-বিচ্যুত নামায আখ্যা দেয়া।
এটা এতটাই ভয়ংকর বিচ্যুতি যে, এ ব্যাপারে যত নিন্দাবাদই করা হোক তা অতিঅল্প। এ মতবাদটি প্রচার-প্রসার الفساد فى الأرض তথা ‘জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি’র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই।
হাদিস ও আসারের সুবিশাল ভাণ্ডার থেকে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে কিছু হাদীস বাছাই করা, এরপর নিজের পক্ষ থেকে তার শর্‌হ ও ব্যাখ্যা প্রদান করে একে অকাট্যরূপে ‘নববী নামায’ দাবি করা এবং পূর্ববর্তী ইমামগণের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত নামাযের অন্যান্য পদ্ধতিকে নববী নামায থেকে বহির্ভূত আখ্যা দেয়া এবং নিজের ইজতিহাদ ও চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে নির্বাচিত নামায-পদ্ধতিকে ওহীর মত সকল মুসলিমের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা যে ইলমী ময়দানে কত বড় বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং إحناث في الدين এর কত জঘন্য ও ভয়ানক রূপ, একমাত্র মুহাক্কিক ও ন্যায়নিষ্ঠ আলেমগণই তা আন্দাজ করতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ও দলীল ভিত্তিক তথ্য ও আলোচনার প্রয়োজন হলে মারকাযুদ্দাওয়া আলইসলামিয়্যা ঢাকা থেকে প্রকাশিতব্য নামায-পদ্ধতি বিষয়ক কিতাবটির সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
৫. সুব্‌হাহ (তাসবীহ) যা দ্বারা গণনা করা হয়, তাকে বিদ’আত আখ্যা দেয়া।
সুব্‌হাহ (তাসবীহ) যা দ্বারা গণনা করা হয়, তাকে বিদ’আত আখ্যা দেয়া। (সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ১/১৮৫-১৯৩) অথচ এর ব্যবহার জায়েয হওয়ার ব্যাপারে এতটুকুই যথেষ্ট যে, এর নিষিদ্ধ হওয়ার কোন দলীল নেই। তারপরও শরয়ী দলীল দ্বারা এর ব্যবহার জায়েয বলে প্রমাণিত। পূর্ববর্তীদের কেউই একে বিদ’আত বলেননি। বিদ’আতের শরয়ী অর্থ সম্পর্কে যার স্পষ্ট ধারণা নেই, একমাত্র এমন ব্যক্তিই তাস্‌বীহ ব্যবহার করাকে বিদ’আত বলতে পারে। আলবানী সাহেবের এ মতটি খণ্ডনে শায়খ ইসমাঈল আনসারী রচিত وصول التهاني بإ ثْات سنية السبحة والرد على الألباني কিতাবটি পড়া যেতে পারে।
ফিক্‌হ, ইলমে হাদীস ও অন্যান্য বিষয়ে শায়খ আলবানী রহ. এর শায মতামতের সংখ্যা প্রচুর। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হল, জনাবের তাসহীহ-তাযয়ীফের উদ্দেশ্য শুধু হাদীস যাচাই-বাছাই মানুষের জন্য সহজ করা নয়; বরং পর্দার অন্তরালে মানুষকে ‘নাক্‌দুস সালাফ’ ও ‘ফিক্‌হুস সালাফ’ তথা সলফের তাসহীহ-তাযয়ীফ ও ফিক্‌হ থেকে সরিয়ে ‘নাক্‌দুল আলবানী’ ও ‘ফিক্‌হুল আলবানী’এর তাকলীদে নিয়োজিত করা। কথাটা তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য। কার্যক্ষেত্রে এমনই হচ্ছে।
যদি ব্যাপারটা এমন না হত বরং তাসহীহ ও তাযয়ীফের ব্যাপারে আলেম ও তালেবে ইলমদেরকে তথ্য সরবরাহ করা এবং নিজের মতামতকে দালীলিকভাবে পেশ করে দেয়াই উদ্দেশ্য হত তবে হাদীস ও রেওয়ায়াতসমূহের উপর আলোচনা করতে গিয়ে আইম্মায়ে হাদীস এবং পূর্ববর্তী হুফ্‌ফাযে হাদীসের উপর আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। ফিক্‌হ ও ফকীহগণের ব্যাপারে মানুষকে আস্থাহীন করারও প্রয়োজন ছিল না যা তার রচনাবলীর মধ্যে লজ্জাকর ভাবে বিদ্যমান। সবিশেষ বিচ্ছিন্ন মতামতসমূহের তরফদারি এবং নতুন নতুন মতের জন্ম দেয়ারও প্রয়োজন ছিল না। অথচ এসব বিষয়েই তাঁর অন্ধ ভক্ত-অনুরক্তদের দৃষ্টিতে তাঁর কিতাবের মূল আকর্ষণ। বলাবাহুল্য, একজন বিশেষ ব্যক্তির (তাঁর ব্যক্তিত্ব যত উঁচুই হোক না কেন) সিদ্ধান্ত ও পর্যালোচনাকে পূর্ববর্তী সকল ইমামের হাদীস ও ফিক্‌হের অবদানসমূহের উপর আরোপিত করা এবং তাদের সবার শুদ্ধাশুদ্ধি পরীক্ষার জন্য একেই একমাত্র কষ্টিপাথর মনে করা অন্ধ তাকলীদের এবং অনধিকার চর্চার একটি জঘন্যতম রূপ।
৭. শায়খ আলবানীর ভ্রান্তিসমূহের খণ্ডনে নির্ভরযোগ্য আলেমগণের কিছু কিতাব।
1.মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আযমী রহ কৃত الألباني شذوذه وأختناؤه.
2.শায়খ ইসমাঈল আনসারী (সাবেক গবেষক, কেন্দ্রীয় দারুল ইফ্‌তা, সৌদি আরব) কৃত تصحيح صلاة التراويح عشرين ركعة والرد على الألباني ءي تضعيفه
3.শায়খ ইসমাঈল আনসারী রহ কৃত إباحة التحلي بالذهب المحلق للنساء الرد على الألباني في تحريم.
4.শায়খ হামুদ তুয়াইজারী (সৌদি আরব) কৃতالعارم المشهور على أهل التبرج والسفور، وءيه الرد على كتاب الحجاب للألباني
5. আবু মুয়াজ তারেক বিন আউযুল্লাহ (বিশেষ ছাত্র, শায়খ আলবানী রহ.) কৃতالنقد البناء أسماء في كشف الوجه الكفين للنساء
6.আহমাদ আব্দুল গফুর কৃত ويلك آمن
7.মাহমূদ সাঈদ মামদূহ, মিসর কৃত وصول التهاني بإثبات سنية السبحة والرد على الألباني
8.মাহমূদ সাঈদ মামদূহ, মিসর কৃত تنبيه المسلم إلى تعد الألباني على صحيح مسلم
9.মাহমূদ সাঈদ মামদূহ কৃত التعريف بأوهام من قسم السنن إلى صحيح وضعيف (১৪২১ হিজরী পর্যন্ত কিতাবটির ৬ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে যাতে ‘সুনানে আরবাআ’র কিতাবুল মানাসেক পর্যন্ত ওই সব হাদীসের উল্লেখ আছে শায়খ আলবানী রহ. যেসব হাদীসের ব্যাপারে উসূলে হাদীস এবং জারহ্‌-তাদীলের নীতিমালার ভূল ব্যবহার করে ভূল সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। উল্লেখিত হাদীসের সংখ্যা ১৯০টি। এ ধারায় যদি কিতাবটি অগ্রসর হয় তবে সম্ভবত তা বিশ খণ্ডে সমাপ্ত হবে।)
10.শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. কৃত خطبة الحاجة ليست سنة في مسهل التأ ليف والكتب كما قاله الشيخ الألباني সাবেক প্রফেসর, কুল্লিয়াতুশ শরীয়া, জামি’আ মালিক সাউদ, কুল্লিয়াতু উসূলিদ্দীন, জামি’আ মুহাম্মাদ বিন সউদ আলইসলামিয়া।
আপাতত এই দশটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হল। শায়খ আলবানীর রচনাবলির সমালোচনা ও পর্যালোচনায় লিখিত কিতাবের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। যে ভাইয়েরা সাধারণ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য আলবানী রহ.এর ‘সিফাতুস সলাত’, ‘সিলসিলাতুয্‌ যয়ীফা’এর বাংলা অনুবাদ করেছেন, তাদের ব্যাপারে কি আমরা এই আশা করতে পারি যে, তারা উপরোক্ত কিতাবসমূহেরও বাংলা অনুবাদ পাঠকদের সামনে পেশ করবেন? বরং এসব কিতাবের উপর যদি কোন গবেষক দলীল ভিত্তিক মার্জিত কোন কিছু লিখে থাকেন তবে তাও বাংলায় অনুবাদ করে দিতে পারেন। এতে আমাদের পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই। যেসব বিষয়ে একাধিক মত রয়েছে তার গবেষণা ও সিদ্ধান্তের জন্য যদি সাধারণ জনগণের সামনে তথ্যাবলীই পেশ করতে হয় তবে একতরফা না হয়ে উভয় পক্ষের তথ্যাবলীই পেশ করা উচিত। অন্যথায় তা ‘তাকলীদে শখ্‌সী’ বা ব্যক্তি তাকলীদই হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ওই সব বন্ধুবর্গ বিষয়টির বিপক্ষে এতটাই সোচ্চার যে, এমনকি শরীয়তসম্মত পন্থায়ও তা অবলম্বন করতে নারাজ।
প্রশ্নের উত্তরঃ
১. সাধারণ আরবী জানা পাঠকের জন্য এই কিতাব কক্ষনো উপকারী নয়।
সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফাতি ওয়াল মাওযূআ’-এ যেহেতু তথ্য ও উদ্ধৃতি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, তাই এই কিতাবটি ওই সব গবেষকদের জন্য উপকারী যারা সচেতন, সতর্ক এবং আল্লাহ্‌ চাহেতো কিতাবের ইলমী ও শাস্ত্রীয় ভ্রান্তিসমূহে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা মুক্ত। কিন্তু সাধারণ আরবী জানা পাঠকের জন্য যিনি শাস্ত্রজ্ঞ নন বা যার জ্ঞান পরিধির সীমা এই যে, তাকে কিতাবটি বাংলা অনুবাদের সাহায্যে পড়তে ও বুঝতে হয় তার জন্য এই কিতাব কক্ষনো উপকারী নয়। এ ধরণের ব্যক্তি কিতাবটি পড়ে আলবানী সাহেবের অন্ধ তাকলীদে নিপতিত হওয়ার বরং বহু ভুল ধারণার শিকার হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তারা অনেক সহীহ, হাসান হাদীসকে যয়ীফ মনে করবেন। যে হাদীসটি মওযূ নয় তাকে মওযূ ভেবে বসবেন। ‘সহীহ মুখতালাফ ফী’ অর্থাৎ যে হাদীস সহীহ হওয়ার ব্যাপারে ইমামগণের মতানৈক্য আছে রয়েছে এর প্রকারভুক্ত অনেক হাদীসের ব্যাপারে আলবানী সাহেবের মতামতকেই চূড়ান্ত মনে করবেন এবং পূর্ববর্তী হাদীস ও ফিক্‌হের ইমামগণের ব্যাপারে এই ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হবেন যে, তাঁরা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে যয়ীফ হাদীস দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ করতেন। পাশাপাশি শায়খ আলবানী রহ.এর ভ্রান্তি ও ‘শায’ মতসমূহ দ্বারা প্রাভাবিত হয়ে ভয়ানক নিন্দনীয় তাকলীদের শিকার হবেন।
২. কিতাবটির বাংলা অনুবাদের মান...
এতো গেল মূল কিতাবের অবস্থা, এবার বাংলা অনুবাদটির কথায় আসা যাক।
অত্যন্ত দুঃখনীয় ব্যাপার হল, কিতাবটির বাংলা অনুবাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। শুধু বাস্তব অবস্থাটি জানানোর খাতিরে পাঠকবৃন্দের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলছি যে, অনুবাদক সাহেব আরবী ভাষাই ভালো জানেন না, শাস্ত্রীয় প্রাজ্ঞতা তো অনেক দূরের কথা। কিতাবটিতে যেসব ব্যক্তিবর্গের নাম বা কিতাবের নাম এসেছে তা-ও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আরবী উপস্থাপনাকে বাংলা ভাষায় ভাষান্তরের যোগ্যতা একদমই নেই। এ অবস্থায় কিতাবটির অনুবাদের দশা যে কী হবে এবং পাঠকরা এ থেকে কতটুকু শুদ্ধতা গ্রহণ করবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
যদি এখানে অনুবাদের শুধু হাস্যকর ভ্রান্তিসমূহের ফিরিস্তি দেয়া হয় তাহলে তা একটি স্বতন্ত্র কিতাবের রূপ পরিগ্রহ করবে। নমুনাস্বরূপ কিছু উল্লেখ করা হল:
৬২ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার মধ্যেই এতগুলো ভুল, তাও শুধু নামের উচ্চারণ সংশ্লিষ্ট। কিতাবের এই খণ্ডটি থেকে যদি শুধু উচ্চারণের ভুলই সংকলন করা হয়, তাহলেও একটি পুস্তিকা হয়ে যাবে।
উলূমুল হাদীসের শাস্ত্রীয় পরিভাষাসমূহের অনুবাদের ব্যাপারে অনুবাদকের জ্ঞান ও ধারণা যে কীরূপ তা তার পরিভাষাসমূহের আভিধানিক অনুবাদ প্রচেষ্টা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়ঃ ১. الجرح المبين مقدم علي التعديل এর অনুবাদ করেছেন, “ব্যাখ্যাকৃত দোষারোপ অগ্রাধিকার পাবে নির্দোষিতার উপর।” (পৃ. ৭১, হাদীস নং. ১৪)
অথচ এটি একটি শাস্ত্রীয় মূলনীতি। এর মর্ম হল, কোন রাবীর ব্যাপারে যদি ইমামগণের মতভেদ থাকে এবং এক ইমাম তাকে ‘বিশ্বস্ত’ বলেন আর অপর ইমাম ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মত প্রকাশ করেন এবং তার এই মতপ্রকাশের উপযুক্ত কারণও দর্শান, তাহলে (শর্তসাপেক্ষে) শেষোক্ত ইমামের মতটিই প্রাধান্য পায়।
বলাবাহুল্য, আমাদের অনুবাদক বাক্যটির যে অনুবাদ করেছেন তা থেকে এই মর্ম-উদ্ধার কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। তাছাড়া جرح শব্দের অনুবাদ ‘দোষারোপ’ আর تعديل শব্দের অনুবাদ ‘নির্দোষিতা’ এমনকি আভিধানিক দিক দিয়েও শুদ্ধ নয়।
২. فالحمل في الحديث علي البشكريأولي এর অনুবাদে লিখেছেন, “তার দোষ বর্ণনা করাই উত্তম।” (পৃ. ৭৩, হাদীস ১৭)
এই পারিভাষিক শব্দটির অর্থ হল, “এই বর্ণনার ব্যাপারে ইয়াশকুরিকে অভিযুক্ত করাই অধিক সমিচীন।” পরিভাষার অনুবাদ যদি অভিধান দিয়ে করার চেষ্টা করা হয় তাহলে এ ধরণের দুর্বোধ্য বাক্যই জন্মলাভ করবে বৈ কি!
৩. تصحيح الترمذي এর অর্থ করেছেন, “ইমাম তিরমিযীর বিশুদ্ধকরণের।” (পৃ. ৮০, হাদীস নং. ২৪)
বলাবাহুল্য, এটা পানি বিশুদ্ধকরণের মত কোন ব্যাপার নয়। এখানে আরবী تصحيح শব্দটি পারিভাষিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হল, ‘বর্ণনার ব্যাপারে ‘সহীহ’ হওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া’। আর এটাও তো অতি সহজ কথা যে, কোন বিবরণকে বাস্তব বা অবাস্তব ‘বানানো’ যায় না, বাস্তব বা অবাস্তব হওয়ার ঘোষণা দেয়া যায় মাত্র।
৪. بخطئ علي الثقات এর অনুবাদ লিখেছেন, “তিনি নির্ভরশীলদের বিপক্ষে ভুল করতেন। (পৃ. ৭৯, হাদীস ২৪)
‘নির্ভরশীল’দের পক্ষে ভুল করাও কি গ্রহণযোগ্য? আসলে তিনি যা করতেন তা হল, ‘নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে বর্ণনা করার সময় ভুল করতেন।’ এই মন্তব্যে বোঝানো হচ্ছে যে, ভুলটি আসলে তারই হত, যিনি তাকে হাদীস শুনিয়েছেন তার নয়। কেননা তিনি তো নির্ভরযোগ্য।
ছোট আরেকটি কথা, ثقة শব্দটির অর্থ কিন্তু ‘নির্ভরশীল’ নয়, ‘নির্ভরযোগ্য’। তাঁরা নির্ভরযোগ্য, আর আমরা তাদের প্রতি ‘নির্ভরশীল’। অনুবাদের অসংখ্য স্থানে ‘নির্ভরযোগ্য’ ব্যক্তিদেরকে ‘নির্ভরশীল’ বানিয়ে দেয়া হয়েছে!
৫. وعمر هذا عامة أهاديثه لا يتابعه الثقات عليه এর তরজমা করেছেন, “নির্ভরশীল বর্ণনাকারী গণ এই উমারের হাদীসগুলোর অনুসরণ করেননি। (পৃ. ১০৪)
‘অনুসরণ’ শব্দটিই এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কেননা বিষয়টি হাদীস অনুসরণের নয় মোটেও। ‘হাদীস-যাচাই’ পর্ব এবং এ পর্বে উত্তীর্ণ হাদীসগুলোর ক্ষেত্রে আসবে ‘হাদীস-অনুসরণ’এর পর্ব। আমাদের আলোচ্য বাক্যটির প্রথম পর্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় পর্বের সাথে নয়। বাক্যটিতে বলা হয়েছে, ‘উমারের অধিকাংশ বর্ণনাই এমন যার সমর্থনে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবীদের কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।’
বোঝানো হচ্ছে, রাবীটির অধিকাংশ বর্ণনাই শাস্ত্রীয় বিচারে ‘শায’ বা ‘মুনকার’। সুতরাং রাবী হিসেবে তিনি অগ্রহণযোগ্য।
লক্ষ করুন, এখানেও কিন্তু শব্দটি ‘নির্ভরশীল’!
৭৬ পৃষ্ঠায় جاه বাক্যটির অর্থ করেছেন, “সত্তা”; অথচ এর অর্থ হল “পদমর্যাদা”।
৭৭ পৃষ্ঠায় لقنها حذتها বাক্যটির অনুবাদ করেছেন, “তাকে উপাধি দাও তার অলংকার হিসেবে।” অর্থ হবে “তাকে তার দলীল শিখিয়ে দাও।”
৮৭ পৃষ্ঠায় بحق السائلين عليك বাক্যটির অনুবাদ করেছেন, “তোমার নিকট প্রার্থনাকারীদের সত্য জানার দ্বারা।” সঠিক অর্থ হল, “তোমার কাছ থেকে প্রার্থনাকারীদের যে দাবি রয়েছে, তার ভিত্তিতে...” দানশীল প্রভুর দানশীলতাই প্রার্থনাকারীর দাবি প্রতিষ্ঠা করে। ‘সত্য জানা’ শব্দটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
৪৬৫ নং হাদীসের إن لغة إسماعيل كانت قد এর অনুবাদ করেছেন, “ইসমাঈলের ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেছিল?” অথচ এর অর্থ হল, “ইসমাঈলের ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।”
আরবী ইবারত বোঝার এবং রাবী ও মনীষীদের জন্ম-মৃত্যু-সন-তারিখ জানার ব্যাপারে অনুবাদকের অবস্থা যে কীরূপ অবর্ণনীয় তা নিম্নোক্ত দৃষ্টান্ত থেকেই স্পষ্ট হয়। কিতাবটির ভূমিকায় ইমাম নবভী রহ.এর বক্তব্য- قال العلماء من المحدثين والفقهاء بحوز ويستحب العلمل بالضعيف في قفاتل الأعمال এর অনুবাদ করেছেন, “মুহাদ্দিস এবং ফকীহগণের মধ্যে কতিপয় আলেম বলেন, ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা জায়েয এবং মুস্তাহাব...।” অথচ বিশুদ্ধ অনুবাদ হবে, “সকল মুহাদ্দিস ও ফকীহ আলেম বলেছেন, ‘ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা জায়েয এবং মুস্তাহাব...।’”
অনুবাদকের কৃত অনুবাদটি তখনই শুদ্ধ হত যদি আরবী বাক্যটি এরূপ হত قال طائقة من العلماء বা قال العلماء
৫১-৫২ পৃষ্ঠায় তো এমন জগাখিচুড়ি পাকিয়েছেন যে, ইবন্‌ হুমামের (জন্ম ৭৯০হি.-মৃত্যু ৮৬১হি.) ব্যাপারে বলেছেন, তিনি নাকি জালালুদ্দীন দাওওয়ানীর (জন্ম ৮৩০হি.-মৃত্যু ৯১৮হি.) বরাতে অমুক কথাটি উল্লেখ করেছেন...। এ বলে অনুবাদক ইবনুল হুমামের উপর আপত্তি উত্থাপন শুদ্ধ করেছেন। অথচ এসব কিছুর মূলে হল আলবানী সাহেবের বক্তব্য না বোঝা। সেখানে ইবনুল হুমামের বক্তব্য ভিন্ন এবং জালালুদ্দীন দাওওয়ানীর বক্তব্য ভিন্ন। ইবনুল হুমাম জালালুদ্দীন দাওওয়ানী থেকে কিছুই উদ্ধৃত করেননি। কিন্তু আরবী ভাষায় আলোচনার শুরু ও শেষ ধরতে না পারায় তিনি উপরোক্ত বিভ্রান্তিতে পতিত করেছেন। ৫৩ পৃষ্ঠায় সূরা নাহলের ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াত فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ এর অনুবাদ করেছেন, “তোমরা না জানলে জ্ঞানীদেরকে প্রশ্ন করে দলীল সহকারে জেনে নাও।”
অথচ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ বাক্যাংশটি ৪৩ নং আয়াতের সূচনা وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُّوحِي إِلَيْهِمْ সংযুক্ত। আয়াত দুটির সঠিক অর্থ হচ্ছে-“আমি আপনার পূর্বে পুরুষদেরকেই রসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের নিকট প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি। সুতরাং তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর। তাঁদেরকে প্রেরণ করেছি নিদর্শনাবলি ও (অবতীর্ণ) গ্রন্থ সহ এবং আপনার প্রতি কুর’আন অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তারা যাতে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।”
চিন্তার ব্যাপার হল এই যে, যিনি কুর’আনুল কারীমের আয়াতের অনুবাদের ক্ষেত্রে এ ধরণের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন, তিনি সাধারণ কোন কিতাবের অনুবাদের ব্যাপারে কী দায়িত্বের পরিচয় দিবেন?
আয়াতের অনুবাদের ভ্রান্তির কারণে আয়াতের যে ‘তাহ্‌রীফ’ ও বিকৃতি তিনি করেছেন তা তো আপন স্থানে আছেই; এ ছাড়া তিনি যেন এই ভুল তরজমার ভিত্তিতে প্রমাণ করতে চান যে, কোন সাধারণ মানুষ আলেমগণের নিকট মাসাআলা জিজ্ঞাসা করলে তার দলীলও জিজ্ঞাসা করে নিবে। দলীলের উল্লেখ ছাড়া কোন আলেমের মাসাআলা গ্রহণ করবেন না!!! নাউযুবিল্লাহ্‌।
সাধারণ মানুষ যদি দলীল বোঝার যোগ্যই হত তবে তো আর আলেমকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন ছিল না। এও কি সম্ভব যে, কুর’আনুল কারীম সাধারণ মানুষকেও দলীল-প্রমাণ এবং এ সংক্রান্ত হাজারো শাস্ত্রীয় জটিলতা সমেত মাসাআলা জানতে বাধ্য করবে?
আকমাল সাহেবের অনুবাদটির আরেকটি বড় ত্রুটি এই যে, তিনি অনুবাদের বহু স্থানে মূল কিতাবের বহু বাক্য, কোথাও এক বা একাধিক প্যারা, আবার কোথাও একাধিক পৃষ্ঠার আলোচনা একদম উড়িয়ে দিয়েছেন; যার অনুবাদের ধারে কাছেও তিনি যাননি। তার এই নীতির (?) কথা না তিনি তার মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন, না সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে এ ব্যাপারে কোন নোট দিয়েছেন। এ আচরণ যে বস্তুনিষ্ঠ অনুবাদের নীতি বিরোধী, তা তো বলাই বাহুল্য।
সকল ভুল এক পর্যায়ের নয়। উপরোক্ত ভ্রান্তিগুলো এমন যে, এর যে কোন প্রকারের দুএকটি ভুলও পুরো অনুবাদের ব্যাপারে আস্থা বিনষ্ট করে দেয়।
আমার বুঝে আসে না, শায়খ আকরামুজ্জামান, এর কী সম্পাদনা করেছেন এবং ড. আসাদুল্লাহিল গালিব এই অনুবাদের ব্যাপারে প্রশংসাসূচক মতামত কীভাবে দিয়ে দিলেন?
(৩)........
সাধারণ পাঠকদের জন্য এ কিতাবে আরো যে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর তা হল, কিতাবটিতে অনেক হাদীস এমন আছে যার সনদসমূহ যদিও সহীহ নয়, কিন্তু উক্ত বিষয়েই অন্য হাদীস রয়েছে যা সহীহ অথবা সেই সব হাদীসে যে বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে তা অন্য কোন শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত অথবা কথাটি যদিও হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়, কিন্তু তা একটি উপদেশমূলক কথা, মানুষের চিন্তা ও কর্মে যার ভাল প্রভাব রয়েছে। এ জাতীয় হাদীসের দুর্বলতা বর্ণনা করার সময় বা হাদীস হিসেবে তা অপ্রমাণিত হলে এর প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করার সময় অন্তত সাধারণ মানুষের জন্য লিখিত বইপত্রে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত যে, শাস্ত্রীয় বিচারে হাদীসটির মান বর্ণনা করার পাশাপাশি এর মূল বিষয়বস্তুর ব্যাপারে স্পষ্ট করে দেয়া উচিত যে, তার শরয়ী বা দালীলিক মান কী? যাতে হাদীসটির শাস্ত্রীয় আলোচনার দরুন সাধারণ পাঠকের মনে মূল বিষয়ের ব্যাপারে কোন ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয়।
এ কাজটি না আলবানী রহ. করেছেন, তা তাঁর অনুবাদক টীকা-টিপ্পনীর মাধ্যমে তা আঞ্জাম দিয়েছেন। এটি এ কিতাবের (যদি তা জনসাধারণের সামনে পেশ করতে হয়) অনেক বড় ত্রুটি। এ প্রসঙ্গে একটি দৃষ্টান্তঃ
শায়খ আলবানী রহ. حدتএর ব্যাপারে কিছু হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন, এ ব্যাপারে যত হাদীস আছে একটি (২৬নং) ছাড়া সব মওযূ।
আমাদের অনুবাদক حدت এর অনুবাদ করেছেন ‘ধর্মীয় চেতনা’। (বলাবাহুল্য, حدت এর অনুবাদ ‘ধর্মীয় চেতনা’ করা ভুল।)
এরপর লিখেছেন, ধর্মীয় চেতনার ব্যাপারে যত হাদীস আছে সব মওযূ একটি হাদীস ছাড়া তাও যয়ীফ।
একে তো এ কথাটাই বাস্তবসম্মত নয়; কেননা বেশ কিছু আয়াত ও সহীহ হাদীস থেকে ধর্মীয় চেতনার গুরুত্ব বুঝে আসে। যদি এসব আয়াত ও হাদীস নাও থাকত তবুও শরীয়তের উসূল ও কাওয়ায়েদের আলোকে এবং ‘আকলে সালীম’ (সুস্থ বিবেক)এর আলোকেই তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রমাণিত হত।
এ অবস্থায় ধর্মীয় চেতনার গুরুত্ব বর্ণনা না করে এমনই বলে দেওয়া যে, ধর্মীয় চেতনার ব্যাপারে যত হাদীস আছে সব মওযূ শুধু একটি হাদীস ছাড়া... কী ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে? একজন সাধারণ মুসলমান এ বক্তব্যটি পড়ে এই সংশয়ে নিপতিত হবে যে, ধর্মীয় চেতনা এমন কি খারাপ জিনিস যে এ ব্যাপারে যত হাদীস আছে সবই মওযূ।
(৪).
কারো ইলমী মাকাম নির্ধারণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের লোক নন এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ.এর ব্যাপারে আপনি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, এ জাতীয় বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তা কোন শাস্ত্রজ্ঞ মুহাদ্দিসের হওয়া জরুরী ছিল।
কারো ইলমী মাকাম নির্ধারণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের লোক নন এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শায়খ আলবানী রহ.এর ব্যাপারে কোন শাস্ত্রজ্ঞ ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি থেকে এ জাতীয় কোন সনদের কথা আমাদের জানা নেই। এ কথা সত্য যে, তিনি জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারায় কয়েক বছর শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তাঁর নতুন নতুন মতামত উদ্ভাবনের ফলে তৎকালীন সৌদির ধর্মীয় নেতা শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করেন এবং তাঁকে জামিয়া ইসলামিয়ায় অবস্থানের সুযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি দামেস্কে অবস্থান করে তাঁর রচনাকর্ম অব্যাহত রাখেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওখানেই অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ২২ জুমাদাল উলা ১৪২০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ক্ষমা করুন; তাঁর ভাল অবদানসমূহ দ্বারা উম্মতকে উপকৃত করুন; তাঁর রচনাবলির মন্দ প্রভাব থেকে সকলকে মাহফুয রাখুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দান করুন। আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন!