menu 2

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Monday, March 9, 2015

কুরআনে মহান স্রষ্টাই আমাদের উদ্দেশে কথা বলছেন







প্রফেসর ওয়াল্টার ওয়াগনার
[অনেক বছর ধরে কুরআন শরিফ সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করে নেতৃস্থানীয় আমেরিকান গবেষক প্রফেসর ওয়াগনার এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে, এই পবিত্র গ্রন্থের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বের সব মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। এই বক্তব্যই ওয়াগনার পাঠক, শিক্ষার্থী এমনকি নিজেকেও জানাতে চেয়েছেন গভীরতর উপলব্ধির জন্য। তার লেখা ওপেনিং দি কুরআন (কুরআনকে উন্মুক্ত করা) একটি বিস্ময়কর বই, যা মুসলিম-অমুসলিম এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী নির্বিশেষে সবাইকে প্রেরণা জোগাবে। বইটিতে অনন্যভঙ্গিতে ধাপে ধাপে আল কুরআনের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আংকারা থেকে প্রকাশিত সানডে’জ জামান পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে কুরআনের সাথে তার পরিচয় সম্পর্কে বিশদ বলেছেন।]


প্রশ্ন : প্রথমে আপনি খ্রিষ্টধর্মের আদিযুগের ওপর কাজ করছিলেন। তাই জানতে ইচ্ছা করে, আল কুরআন সম্পর্কে বই লেখার প্রেরণা পেলেন কিভাবে?
উত্তর : বিশ বছরেরও বেশি দিন ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে এটি লিখেছি। আমি মনে করি, মাত্র কুরআন বুঝতে শুরু করেছি। তবে প্রকৃতপক্ষে ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে শুধু ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতি নয়, ইতিহাসের দিক দিয়েও সম্পর্ক রয়েছে।
অতীতে কোনো কোনো সময়ে আমরা একে অন্যের মাথায় মাথা লাগিয়ে ধাক্কা মেরেছি, অন্যান্য সময়ে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে হয়েছি লিপ্ত। তবে আমরা একই স্রষ্টার উপাসনা করি। অভিজ্ঞতা থেকে বলব, এই উপাসনার জন্য অন্যের ধর্মকে বোঝার পথ খোলা রাখা চাই।
আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, মুসলিম নারী-পুরুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি! বিশেষ করে তুর্কি সম্প্রদায়কে জেনেছি গত সাত বছর। পূর্বোক্ত বইটি লেখার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, পরস্পরকে বোঝা যখন জরুরি, তখন প্রথমে নিজেকে বিষয়টি বুঝানো এবং এরপর অন্যদেরকে বুঝিয়ে বলা।

প্রশ্ন : আপনি যখন কুরআন শরিফ পড়ছিলেন, তখন কার কণ্ঠের কথা আপনার মনে পড়েছিল? কথা বলছিলেন কে?
উত্তর : আমি বিশ্বাস করি, কুরআন প্রত্যাদেশমূলক গ্রন্থ। বিধাতা অনেক ব্যক্তি, অনেক নবী-রাসূল, বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন। কুরআনে আমাদের উদ্দেশে কথা বলে মহান স্রষ্টারই কণ্ঠ। এটি শান্তি ও সুবিচারের কণ্ঠ। এই কণ্ঠ সে সব মানুষের কথা বলে যারা শান্তিতে একত্রে থাকা দরকার মনে করে আর প্রয়োজন বোধ করে বিশ্বের অন্য সবার জন্য এক হয়ে কাজ করার। আমি সেই কণ্ঠ শুনেছি। সেই কণ্ঠ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের এবং আমার উপলব্ধি গভীর করার জন্য নিজেকেও শোনাতে চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন : আপনি আরবি পড়তে পারেন কি না নিশ্চিত নই। সম্ভবত অনুবাদের ওপর জোর দিয়েছেন। কিভাবে কাজ করেছেন, অধ্যয়ন করলেন?
উত্তর : অমুসলিম হিসেবে কুরআন প্রথম কয়েক দফা পড়াটা সম্ভবত বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমরা যারা বাইবেলের ঐতিহ্য থেকে এসেছি, তাদের প্রত্যাশা হলো কুরআনেও বাইবেলের জেনেসিস, এক্সোডাস কিংবা গসপেল অব মার্কের মতো বিভিন্ন অধ্যায়ের দেখা পাবো। হ্যাঁ, কুরআনেও বিভিন্ন অংশে ভাগ করা আছে। সবগুলো মিলে একটি পূর্ণরূপ পেয়েছে। কুরআন বারবার পড়তে হয়। এ বিষয়ে চিন্তা করতে হয় বারবার আর বোঝার জন্য মাথা চুলকাতে হয় বহুবার। তবে আমি মনে করি, প্রথম পদক্ষেপ হলো, উৎসাহ না হারানো। পয়লা পরামর্শ দেবো, কুরআনকে পেছন থেকে শুরু করে সামনের দিকে পড়–ন নবীকে বোঝার জন্য। তাঁর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। কুরআনের সাথে অন্যরা কী বলেছেন, তা-ও পড়তে হয়।

প্রশ্ন : বাইবেলীয় ঐতিহ্য ও কুরআনের মিলগুলো কী কী, আর গরমিলই বা কী, আমাদের বলুন।

উত্তর : মৌলিক পার্থক্য হলো, বাইবেল ও কুরআনের পরস্পর থেকে ভিন্ন প্রকৃতি। অবশ্য বাইবেল ও কুরআনে অভিন্ন ত্রিশজন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। একটি বিষয় হলো (মুসলিম শিক্ষার্থীরাও যার সাক্ষ্য দেবে), উভয় গ্রন্থে কোনো কোনো সময়ে আমরা একই ভাষা ও শব্দ পাই। তবে মূলনীতি ও ধারণা পরস্পর পৃথক।

মুসলমানরা বিশ্বাস করে, কুরআনের প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেক বর্ণ আল্লাহ-প্রদত্ত। বাইবেল সম্পর্কে খ্রিষ্টানরা এটা মনে করে না। নির্দিষ্ট কোনো ভাষার প্রতি খ্রিষ্টানদের বিশেষ আকর্ষণ বা শ্রদ্ধা নেই। আমরা বাইবেলের অনুবাদ পড়তেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এর পাণ্ডুলিপির বিভিন্নতা এবং একই কাহিনীর নানারকম বয়ান দেখেও আমি অস্বস্তি বোধ করি না। মুসলিম ছাত্রছাত্রী জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘আসল ঘটনা কী?’ খ্রিষ্টান হিসেবে আমার কাছে এটা সমস্যা নয়। তবে শিক্ষক হিসেবে মুসলমানদের কাছে এর ব্যাখ্যা দেয়া এবং মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।

আমরা খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা অভিন্ন অনেক নবীর ওপর বিশ্বাস রাখি। তবুও তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা পৃথক। আমাদের উভয়ের একই বিশ্বাস যা, তা হলো একজন মহান সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি তাঁর প্রতি বাধ্য থাকতে বলেন। তিনি বিশ্বাসীদের একটি সমাজ নির্মাণ করতে বলেন, যারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ ও উপাসনার জন্য উৎসর্গিত। অবশ্য, বার্তাবাহক ও নবী বলতে কী বুঝায়, সে ব্যাপারে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মাঝে বড় পার্থক্য আছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন নবী শুধু ঐশী প্রত্যাদেশপ্রাপ্তই নন, তাঁকে পরিপূর্ণও হতে হবে। তাই বাইবেল পড়ে মুসলমানরা কারো কারো ব্যভিচার ও খুন করা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কারণ এগুলো ঘৃণ্য অপরাধ। তাদের প্রশ্ন, ‘যারা এমন পাপী, তোমরা তার অনুসরণ কিভাবে করতে পারো?’

প্রশ্ন : খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে ঈসা আ:, মুহাম্মদ সা: এবং অন্যদের কিভাবে চিত্রিত করা হয়েছে? তাঁদের মিল-অমিল কী কী?
উত্তর : আমার মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সব সময়ই তাদের খ্রিষ্টান সহপাঠীদের অবাক করে দেয়, যখন তারা জানায়, ‘ভালো মুসলিম হতে হলে ঈসা আ:-এর ওপরও ঈমান আনতে হবে।’ তিনি কুমারী মাতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। অলৌকিক কাজকর্ম করেছেন; তিনি ক্ষুধার্তকে খাইয়েছেন, রুগ্ণকে করেছেন সুস্থ, মৃতকে করেছিলেন পুনর্জীবিত। তাঁকে মসিহ বলা হয়। পৃথিবীর শেষ যুগে তিনি আসবেন আবার। তিনি ছিলেন শিক্ষক; তাঁর ছিল শিষ্য। তিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথ অনুসরণের দিকে। কুরআনে ঈসা আ:-কে এভাবে তুলে ধরার সাথে বাইবেলের মিল রয়েছে। অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মূল পার্থক্য হলো, ঈসা আ:-কে ক্রুশে বিদ্ধ করা এবং তাঁর পুনরুত্থান প্রসঙ্গ।

মূসা আ:-সহ অন্য নবীদের কয়েকজন প্রসঙ্গে কুরআনে যা বলা হয়েছে, তার সাথে মিল আছে ইহুদিদের বিশ্বাসে। অর্থাৎ এই দুইয়ের মাঝে সঙ্ঘাত নয়, সম্পর্ক বিদ্যমান। আর আমি সহজ কথায় যা বুঝি, তা হচ্ছে মূসা আ: এলেন এবং সরকারকাঠামো প্রতিষ্ঠা করলেন। অপর দিকে ঈসা আ: এসে মানুষকে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াই। খ্রিষ্টানরা পরবর্তীকালে এটা যোগ করেছে। নবী মুহম্মদ সা: এলেন। তিনি এমন একজন, যাঁর ‘পার্থিব’ ও ‘আধ্যাত্মিক’ দু’টি দিকই আছে। তিনি উভয়কে একত্র করেছেন। স্রষ্টা বিশ্বকে ভালোবাসেন এবং এর পরিচর্যা করেন। অতএব আপনাদেরকেও অবশ্যই এ কাজ করতে হবে। একই বিধাতা নবীদেরকে পাঠিয়েছেন।

প্রশ্ন : কুরআন অধ্যয়ন করে কিভাবে প্রভাবিত হয়েছেন? এটা কি আপনার জীবনে কোনোভাবে পরিবর্তন এনেছে?
উত্তর : এর মাধ্যমে যে ক’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে, তার একটি হলো আমি নামাজের ভিত্তিতে ইসলাম ও কুরআন বুঝতে পেরেছি। নামাজের খুবই পবিত্র একটা অনুভূতি আছে এবং নামাজের মধ্য দিয়ে একটি জীবন গড়ে তোলা যায়। ইসলাম সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ বুঝেছি। এতে ধারণা হয়েছে, এই ধর্মের ভিত্তি হলো সৃষ্টিতত্ত্ব। আমার ওপর এ বিষয়টির প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে নৈতিকভাবে।

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য
লেখক : মার্কিন ধর্মতত্ত্ববিদ; ‘যিশুর শিষ্যদের যুগের পরে দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিষ্টধর্ম’সহ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম

অভিজিৎ হত্যা ও বাংলাদেশের রাজনীতি


অভিজিৎ হত্যা ও বাংলাদেশের রাজনীতি
-এরশাদ মজুমদার
০৭ মার্চ ২০১৫,শনিবার, ১৮:১৯
অভিজিৎ হত্যা একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক দুঃখজনক ঘটনা। আমি অন্তর থেকে এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছি। অভিজিৎ একজন শিক্ষিত মুক্তমনের মানুষ। বিদেশে থাকেন। মুক্তমন নামের একটি ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। সালমান রুশদি যেমন মুক্তমন নিয়ে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নামে একটি বই লিখে জগৎজোড়া নাম কামিয়েছেন, এর পরে বাজারে তার দামও বেড়েছে। ব্রিটিশ সরকার তাকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন। বড় বড় মঞ্চে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত হচ্ছেন। লেখক হিসেবে তিনি বড় মাপের লেখক। শয়তানের কবিতা বা শয়তান কাব্য না লিখলেও তিনি বড় লেখক থাকতেন। তবুও তিনি শয়তানের কাব্য লিখেছেন। যখন বইটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী হইচই পড়েছে, তখনো আমি লিখেছিলাম চৌদ্দ শ’ বছর ধরেই তো জগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষ নবীজী সা:-এর বিরুদ্ধে কিছু লোক লিখে চলেছেন। অনেকেই আল্লাহ পাকের বিরুদ্ধে লিখেও নাম কামাচ্ছেন। এতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা:-এর কিছু আসে-যায় না।
ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধার্মিক মানুষ মুক্তমনের হতে পারেন। অন্তত আমি তাই মনে করি। একজন অবিশ্বাসী মানুষও ভালো হতে পারেন। আবার বিশ্বাসী মন্দ হতে পারেন। বহু লেখাপড়া জানা মানুষকে আমি মন্দ হতে দেখেছি। স্টিফেন হকিন্স জগদ্বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানী। তিনি জগতের সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন। জগতের সব মানুষই তাকে সম্মান করেন। তিনি কখনো স্রষ্টাকে বা ধর্মকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেননি। তার মতো জগদ্বিখ্যাত আরো অনেক মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, যারা কখনোই ধর্মকে নিয়ে তামাশা করতেন না। মুক্তমনের মানুষ মানেই তো হচ্ছে উদার মনের মানুষ। যারা পরের মত বা বিশ্বাসকে সব সময় সম্মান করেন। আমি মাঝে মাঝে বিদেশী নাস্তিক ও যুক্তিবাদীদের ওয়েবসাইট ভিজিট করি তাদের যুক্তিগুলো জানার জন্য। এদের বেশির ভাগই যুবক। এদের ভেতর খুব অল্প ক’জনকে দেখেছি বাজে কথা বলেন ও গালমন্দ করেন।
এক সময়ে ইসলামে মুতাজিলা নামের একটি গ্রুপ ছিল। এরা ছিলেন যুক্তিবাদী। বিনা প্রমাণে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আব্বাসিয়া আমলে এদের বিকাশ হয়েছিল। এ চিন্তাধারার মানুষ এখন জগতে নেই। এরা বলতেন, জ্ঞান লাভের প্রধান হাতিয়ার হলো জিজ্ঞাসা করা। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে ফরজ বা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসলামের মূলমন্ত্র হচ্ছে মানবতা, মানবসেবা। আমি মনে করি, স্রষ্টা হচ্ছেন জ্ঞানের প্রতীক। তাই মানুষকে জ্ঞান সাধনা করতে হবে। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, know thyself. নিজেকে চেনো। আর ইসলাম বলে, ‘মান আরাফা নাফসা, ফাকাদ আরাফা রাব্বা।’ এর মানে, আগে নিজেকে চেনো, তাহলেই তুমি প্রভুকে জানতে বা চিনতে পারবে। আমাদের বাংলাদেশের তথাকথিত জ্ঞানী সমাজ নিজেকে চেনে না। কারণ, জ্ঞানসাধনা না করেই তারা সমাজে সম্মানিত। হজরত আলী রা:-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সমাজ বা দেশ অসুস্থ হয়ে গেছে কিভাবে জানা যাবে। তিনি বলেছিলেন, যে সমাজে দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হয়ে গেছেন, ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছেন, জ্ঞানীরা পালিয়ে গেছেন, মূর্খরা মঞ্চে বসে থাকেন, বিচারকেরা রাজা বা খলিফার তাঁবেদারি করেন এবং রাজা মিথ্যা কথা বলেন। আপনারা নিজেরাই ভাবুন আমাদের প্রিয়তম মাতৃভূমি বা রাষ্ট্র এখন কেমন আছে।
বাংলাদেশে ব্লগার শব্দটির একধরনের নেগেটিভ বা নেতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। পরমত বা ধর্মবিশ্বাসকে গালমন্দ করে কিছু শিতি তরুণ কিছু ব্লগ সৃষ্টি করে লেখালেখি করেছে। শুনেছি, সরকার নাকি ওসব ব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে। অভিজিৎ একজন ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক। এখন তার নাম হয়ে গেছে ব্লগার অভিজিৎ। কেমন যেন মনে হয় তার বোধ হয় আর কোনো পরিচয় নেই। তিনি আমেরিকায় থাকেন, মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসেন। সমমনা বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করেন। আবার আমেরিকায় ফিরে যান। আমাদের দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে মুক্তমনাদের দাম বা কদর বেশি। অভিজিৎকে নিয়ে দেশে-বিদেশে এখন হইচই চলছে। এমন প্রতিক্রিয়া সাধারণত দেখা যায় না। এ ব্যাপারে পশ্চিমা জগতের সাথে আমাদের দেশের মুক্তমনারা এক কাতারে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সে কারণটা কী?
চলমান সময়ে বা চলতি সপ্তাহে অভিজিৎ বিশ্বের এক নম্বর ব্যক্তি। সৌদি আরবে এক ব্লগারকে সৌদি আদালত দশ বছর জেল ও এক হাজার বেত্রাঘাত শাস্তি দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শাস্তির নিন্দা করি। এ ব্যাপারে পশ্চিমা মিডিয়া অনেক লেখালেখি করছে। কিন্তু সরকারগুলো চুপ। কারণ, ঘটনাটা সৌদি আরবের। কেউ সৌদি বাদশাহকে ঘাঁটাতে চায় না। বাদশাহর বন্ধুত্বকে কেউ অবহেলা করতে চায় না। সৌদি সরকার সেকুলার বা ধর্মহীন নয়। বাংলাদেশ সরকার সেকুলার। তাই ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে এমন সরকার দেখতে চায়। এটা আদর্শ ও দর্শন স্বার্থগত ব্যাপার।
গত বছর কিছু দিনের জন্য আমি আমেরিকার সিয়াটল শহরে ছিলাম। এটা মাইক্রোসফটের শহর। এ শহরের প্রধান দৈনিক সিয়াটল টাইমস। ক্যাথি বেস্ট হচ্ছেন সম্পাদক। তার অফিসে গিয়েছিলাম মতবিনিময়ের জন্য। প্রায় ঘণ্টাখানেক ছিলাম। তখন সেকুলারিজম নিয়ে তার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, এখানে ৫৭ ভাগ মানুষ সরাসরি ধর্মে বিশ্বাস করে। তবে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। ওই কাগজে ধর্ম বিষয়ে একটি কলাম আছে। সপ্তাহে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সব ধর্মের লোকেরাই লিখতে পারেন। তবে ধর্মবিরোধী কোনো মত ছাপা হয় না। বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষিত ধর্মহীনের (সেকুলার) কদর বেশি। এরা ধর্ম নিয়ে কথা উঠলেই আলেমসমাজকে গালাগাল করেন। কিন্তু নিজেরা ধর্মজ্ঞান লাভ করেন না। এর আগে বহুবার বলেছি, এ দেশে ধর্মহীন বা ধর্মজ্ঞানহীনেরাই রাষ্ট্রীয় মতায় থাকেন। ধর্মের বিরুদ্ধে যারা জোরগলায় কথা বলেন তারাই পদবি লাভ করেন। আমি মনে করি, ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মহীন বা ধর্মমুক্ত থাকা কোনো অপরাধ নয়। ধর্মমুক্তির আন্দোলনও করতে পারেন। কিন্তু অন্য ধর্মকে গালাগাল করা বা অন্য মতকে নিন্দা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
এখন বুদ্ধিজীবী জ্ঞানীগুণীরা বলছেন, ’৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশবাসীকে ১০০ ভাগ খাঁটি সেকুলার (ধর্মহীন বা ধর্মমুক্ত) বাঙালি বানানোর জন্য। অনেকেই বলেন- শুধু মুক্তিযোদ্ধা হলেই চলবে না, ধর্মহীন চেতনা থাকতে হবে। ভারতও চায় বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলমান যেন ধর্মমুক্ত থাকে। ধর্মচেতনা শক্তিশালী হলে ভারতের দর্শন বাস্তবায়ন হবে না। বাংলাদেশে ধর্মমুক্ত চেতনায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে। এরাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। যদিও সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এটা হচ্ছে ভোটারদের ধোঁকা দেয়ার জন্য।
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হওয়া অবশ্যই দরকার। তাহলে জানা যাবে কারা এমন ঘৃণ্য কাজ করেছে, কেন করেছে। অভিজিৎ নিহত হাওয়ার সাথে সাথে রাজনীতিতে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সরকারি নেতারা বলতে শুরু করেছেন, জঙ্গিরা এ কাজ করেছে। জঙ্গিদের নেতা হচ্ছেন খালেদা জিয়া। নেতা-মন্ত্রীদের এমন সহি বক্তব্যকে তদন্তকারীদের অবশ্যই গাইডলাইন হিসেবে নিতে হবে।
এমন এক সময় অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে যখন দেশ এক মহাসঙ্কটের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এমন সময় অভিজিৎকে হত্যা করার পেছনে কারা আছে এবং কী উদ্দেশ্যে তারা এমন ঘৃণ্য কাজ করেছে, তা অবশ্যই দেশবাসীকে জানতে হবে। সময়কে আরো ঘোলাটে করে কি কেউ রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চাইছে? ডাক্তার মিলন হত্যা হয়েছে রাজনৈতিক ঘোলাটে অবস্থায়। মিলন হত্যার মাধ্যমেই জেনারেল এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। এর আগে সাংবাদিক দুলাল ও শ্রমিক নেতা আবদুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তারও বেশ আগে অ্যাসেম্বলিতে স্পিকারকে হত্যা করা হয়েছে। ব্লগার রাজীব হত্যায় তেমন বেশি রাজনীতি হয়নি, যেমন হচ্ছে অভিজিৎ হত্যা নিয়ে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কথা বলতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। অভিজিৎ নাস্তিক বলে বিদেশেও অভিজিৎকে নায়ক বানানোর চেষ্টা চলছে। অভিজিৎ ব্যক্তিগত জীবনে বিনীত ও হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। কিন্তু মুক্তমনের নামে তিনি ধর্ম নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেন। তার সাথে আরো কিছু আরবি নামধারী যুবক যোগ দিয়েছিল। ফলে কিছু ইসলামপন্থী যুবক নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করে এবং উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে শুরু করে। সরকারের দায়িত্ব ছিল উভয় গ্রুপকে কঠোরভাবে দমন করা। কিন্তু সরকার তা করেনি।
ইসলাম সম্পর্কে সরকার নিরপে ভূমিকা পালন করে। এ দেশে ভোট ছাড়া অন্য কোনো কাজে মুসলমানদের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। শুধু ভোটের জন্যই তারা মেজরিটি। ফলে দেশের ১৪ কোটি মানুষের ধর্মমর্যাদা ও চিন্তা অবহেলিত। ইসলামের ব্যাপারে নিরপেতা আর অন্যদের ব্যাপারে সহমর্মিতা দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মনে বেদনার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষা সংস্কৃতি ইতিহাস কোথাও ইসলামের প্রভাব নেই। ইসলাম মসজিদে ছাড়া আর কোথাও নেই। তবুও বলা হয়- মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। কেউ কেউ বলেন, লিবারেল মুসলিম কান্ট্রি। ইদানীং শুনতে পাচ্ছি পলিটিক্যাল ইসলাম। আমার দৃষ্টিতে ইসলাম একটিই। কিতাব একটি। এর বহু তাফসির বা ব্যাখ্যা থাকতে পারে। একমাত্র ধর্ম ইসলাম যার নিজস্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি আছে। এর আগের কিতাবগুলোও ইসলামের। কালক্রমে সময়ের প্রয়োজনে আল্লাহ পাক নিজেই সংস্কার করে আল কুরআন নামে অভিহিত করে নাজিল করেছেন। কোথাও ধোঁয়াশা নেই, একেবারেই সুস্পষ্ট। এর ভেতর বাঁকা পথ খোঁজেন তথাকথিত ধর্মমুক্ত শিক্ষিতজনেরা। এরা নিজেরা ধর্ম পালন করেন না। ধর্ম যারা পালন করেন, তাদের সমালোচনা করেন। এরাই সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। এরাই মুক্তমনের নামের উগ্রপন্থী নাস্তিক ব্লগার সৃষ্টি করেছেন।
অপর দিকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করে উগ্রপন্থী সৃষ্টি করেছে। এই উগ্রপন্থী তরুণেরাই মনে করে ইসলামের সমালোচকদের হত্যা করতে হবে। ইসলাম কখনোই এ ধরনের শিক্ষা দেয় না। ইসলাম হচ্ছে জগতের সবচেয়ে বেশি সহনশীল উদার ধর্ম। ইসলাম হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মাশীল ধর্ম। আল্লাহ পাকের প্রধানতম গুণ হচ্ছে ভালোবাসা ও মা। মানুষকে বলেছেন, তোমরা আমার ভালোবাসা ও মায় আস্থা রাখো। আমার মা হচ্ছে অসীম সাগর, আর মানুষের অপরাধ হচ্ছে এক বিন্দু পানি। সেই দয়াবান ও ক্ষমাশীল খোদাকে গালমন্দ করে একশ্রেণীর তথাকথিত জ্ঞানী মানুষ আর তাদের অনুসারী বিপথগামী এক শ্রেণীর তরুণ। আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের বেশির ভাগই ইসলাম বা কুরআনকে জানে না। না জানাই নাকি সমাজে তাদের সম্মানিত করেছে। এরাই মানবতা আর মানবিক অধিকারের নামে নারী-পুরুষের সমকামিতা, নারীমৈথুন, লিভ টুগেদার, ধর্মহীন বিয়েকে সমর্থন করে। প্রগতি মুক্তমনের নামে সমাজ বন্ধনকে ধ্বংস করতে চলেছে। খোদা সার্বভৌম বললে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে।
খোদা ও রাসূল সা:-বিরোধী শক্তি আগেও ছিল, আজো আছে। ফেরাউন, নমরুদ ও সাদ্দাদ কখনোই আল্লাহ বিশ্বাস করত না। এরা নবীদের হত্যা করেছে। বিশ্বাসী মানুষদের ওপর অত্যাচার করেছে। আল্লাহ নিজেই খোদাদ্রোহীদের শাস্তি দিয়েছেন। খোদাদ্রোহী জাতিকেও আল্লাহ শাস্তি দিয়েছেন। যেমন- সদম ও গোমোরাহ নগরীকে ধ্বংস করে দিয়ে সেসব নগরীর মানুষদের শাস্তি দিয়েছেন। এখনো জগতে ফেরাউনের মতো শাসক আছে। এখনো প্রকৃতির শোধ আছে। জ্ঞানপাপীরা বুঝতে পারে না। তবে একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, তা হলো মুখোশধারী মুনাফেক। এরা মুসলমান সেজে সমাজে চলাফেরা করে। কিন্তু মুক্তমনের নামে দিনরাত ইসলাম, মুসলমানের বিরুদ্ধে কথা বলে। বাংলাদেশে এ রকম মুনাফেকের সংখ্যা কম নয়। আমরা সমাজে কঠোরভাবে শান্তি রা করতে চাই, কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে বলতে চাই না। মুনাফেকদের আল কুরআনে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এরা কাফেরের চেয়ে খারাপ। এরাই প্রচার করে মাদরাসাশিক্ষা নাকি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীর জন্ম দেয়। এরাই প্রচার করে খতিব, ইমাম মুয়াজ্জিনরা তেমন লেখাপড়া জানেন না ও করেন না। অথচ ইসলামের ব্যাপারে তাদের অ আ ক খ বিদ্যাও নেই। বাংলাদেশে ইসলামের ব্যাপারে এমন বৈষম্য শক্তিশালীভাবে বিরাজ করছে। এরা জানে না ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে (১৭৫৭-১৮৫৮) আলেমসমাজই সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছে। তখন অমুসলমান মুনাফেকরা দখলদার লুটেরা বাহিনীকে সাহায্য করেছে। ’৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়েছে অমুসলমানদের কারণে। ’৭১ সালে মুনাফেকদের কারণেই পাকিস্তানি বেঈমানরা বাঙালি মুসলমানদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার করেছে। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন। সেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে এক শ্রেণীর অমুসলমান ও মুনাফেক। এদের সমর্থন ও সহযোগিতা করছে প্রতিবেশীরা। আজ এদের কারণেই দর্শনগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। মাত্র ৪৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশের এমন হাল করেছে তথাকথিত প্রগতিশীল ও মুনাফেকরা। আল কুরআন না জানার ফলে মুসলমানেরা আজ দ্বিধাবিভক্ত। কুরআন না জানার ফলেই ফারাবী ও অভিজিতের মতো বিভ্রান্ত-বিপথে পরিচালিত তরুণদের জন্ম হয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, জগতে এখন ইসলামের সহনশীল, উদার, মানবিক ধর্ম আর নেই। এ কারণেই আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত ও পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের উত্থানের বিরোধিতা করছে। হার্ভার্ডের শিক্ষক নোয়া ফেল্ডম্যান বলেছেন, গণতন্ত্র কায়েম হলে ও অবাধ নির্বাচন হলে উদারপন্থী মুসলমানেরাই জয়ী হবে। পশ্চিমা ধর্মহীন গণতন্ত্র তাই মুসলমানদের ভয় পায়।
লেখক : কবি ও ঐতিহ্য গবেষক
ershadmz@gmail.com