কবরের নিকট সালাত পড়া, কবরবাসীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা এবং তার উপর প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালানোর অবৈধতা বর্ণনা প্রসঙ্গে
কবর পূজারীদের জন্য অভিশাপ এবং কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد » (أخرجه البخاري ومسلم).
“ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ), তারা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।”[1]
এই হাদিসটি ‘মাসাবীহ’ ( المصابيح ) গ্রন্থের বিশুদ্ধ হাদিসসমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণনা করেছেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের উপর লা‘নত করার কারণ হল, তারা ঐসব স্থানে সালাত আদায় করত, যেখানে তাদের নবীদেরকে দাফন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে হয়তো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যে, তাদের নবীদের কবরসমূহের উদ্দেশ্যে সিজদা করার অর্থ হচ্ছে তাদের নবীদের সম্মান করা; বস্তুত এটা হচ্ছে প্রকাশ্য শির্ক, এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعبد » (أخرجه مالك وأحمد).
“হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তি বানিও না, যার পূজা করা হবে।”[2]
অথবা তাদের ধারণা ছিল যে, তাদের নবীদের কবরের দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের দ্বারা তারা আল্লাহ তা‘আলা’র নিকট মহান মর্যাদা লাভ করবে; কেননা তা দু’টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে: একদিকে আল্লাহ তা‘আলা’র ইবাদত করা এবং অপরদিকে তাদের নবীদেরকে সম্মান করা। বস্তুত তাদের এ জাতীয় ধারণাও গোপন শির্ক (شرك خفي)। আর এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে তাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য সমাধিস্থলে সালাত আদায় করা থেকে নিষেধ করেছেন, যদিও উদ্দেশ্য দু’টি ভিন্ন।
তিনি আরও বলেছেন:
« ... أَلاَ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّى أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ » . (أخرجه مسلم) .
“ ... সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী ও পুণ্যবান লোকদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদ বানিও না। আমি তোমাদের তা থেকে নিষেধ করছি।”[3]
কোন কোন বিশ্লেষক বলেন: পুণ্যবান ব্যক্তিগণের সমাধিস্থলের মত স্থানসমূহে সালাত আদায় করা এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত; বিশেষ করে যখন এই ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হবে কবরবাসীকে সম্মান করা; কেননা, এর মধ্যে শির্কে খফী (شرك خفي) রয়েছে; কারণ, মূর্তি পূজার সূচনা হয়েছিল নবী নূহ আ. -এর জাতির মধ্যে, সমাধিস্থলে তাদের অবস্থান করার কারণে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বলেছেন:
﴿ قَالَ نُوحٞ رَّبِّ إِنَّهُمۡ عَصَوۡنِي وَٱتَّبَعُواْ مَن لَّمۡ يَزِدۡهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥٓ إِلَّا خَسَارٗا ٢١ وَمَكَرُواْ مَكۡرٗا كُبَّارٗا ٢٢ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢١، ٢٣]
“নূহ্ বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের, যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি; আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছে এবং বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে।”[4]
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. ও অন্যান্য পূর্ববর্তী আলেমগণ বলেন: আয়াতে উল্লেখিত ঐসব ব্যক্তিবর্গ ছিলেন নবী নূহ আ. -এর জাতির মধ্যকার সৎ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত; যখন তাঁরা মারা গেলেন, তখন জনগণ তাঁদের সমাধিস্থলে অবস্থান করতে লাগল, অতঃপর তারা তাঁদের প্রতিমূর্তি বানাল, অতঃপর তাদের এই অবস্থার উপর দিয়ে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তারা তাঁদের উপাসনা করা শুরু করল।[5] এটাই হল মূর্তিপূজার গোড়ার কথা; আর ইবনুল কায়্যিম র. তাঁর ইগাসাতুল লাহফান গ্রন্থে এর সমর্থনের তার শাইখের পক্ষ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: নিশ্চয় এটিই হচ্ছে মূল ইল্লত বা কারণ, যার ফলে শরী‘য়ত প্রবর্তক কবরকে মসজিদ বা সালাত আদায়ের স্থান হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। ঠিক সেই কারণটিই অনেক মানুষের জীবনে বাস্তবে ঘটছে; হয় সে শির্কে আকবার বা বড় শির্কের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছে, অথবা এর কাছাকাছি পর্যায়ের শির্কে জড়িয়ে পড়ছে; কারণ, যিনি সৎ ও আস্থাবান, এমন ব্যক্তির কবরের মাধ্যমে শির্ক করাটা গাছ অথবা পাথরের মাধ্যমে শির্ক করার চেয়ে মনের দিক থেকে অধিক কাছাকাছি। আর এ জন্যই আপনি অনেক মানুষকে কবরের নিকট অনুনয় ও বিনয় প্রকাশ করতে দেখতে পাবেন; সেখানে তারা বিনীতভাবে আন্তরিকতা সহকারে এমনভাবে ইবাদত করে, যেমন ইবাদতের কাজটি তারা আল্লাহ তা‘আলার ঘরসমূহের মধ্যেও করে না এবং রাতের শেষ প্রহরেও না। আর তারা সেখানে সালাত আদায়ের দ্বারা এমন বরকত প্রত্যাশা ও প্রার্থনা করে, যে প্রত্যাশা তারা মসজিদসমূহের মধ্যে করে না। সুতরাং এই ধ্বংসাত্মক বিষয়টির মূলোৎপাটন করার জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে সমাধিস্থলে সালাত আদায় করা থেকে নিষেধ করেছেন[6]; যদিও মুসল্লী সেখানে সালাত আদায় করা দ্বারা সে স্থান থেকে বরকত গ্রহণ করার উদ্দেশ্য না থাকে; যেমনিভাবে তিনি সূর্য উদয়ের সময়, অস্ত যাওয়ার সময় এবং স্থির মধ্য আকাশে অবস্থানের সময় সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন; কারণ, এ সময়গুলোতে মুশরিকগণ সূর্যের পূজা করে, তাই তিনি তাঁর উম্মতকে এ সময়গুলোতে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন, যদিও (সে সময়গুলোতে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে) তাদের উদ্দেশ্য মুশরিকদের উদ্দেশ্যের মত নয়।
আর যখন কবরস্থানে সালাত আদায়ের দ্বারা ব্যক্তির উদ্দেশ্য হয় ঐ ভূমির বরকত হাসিল করা, তখন এটা হবে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের সাথে প্রকৃত শত্রুতা করা, তাঁর দীনের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং এমন দীন তথা নতুন বিধিবিধান প্রবর্তন করা, যার অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা দেননি।
ইবাদতের মূলভিত্তি হল অনুসরণ করা, নতুন মত প্রবর্তন করা নয়
ইবাদতের মূলভিত্তি হল অনুকরণ ও অনুসরণ করা, খেয়াল-খুশি ও বিদ‘আতের অনুসরণ করা নয়। মুসলিমগণ তাদের নবীর দীন থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছেন, তার উপর ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ মত পেশ করেছেন যে, সমাধিস্থলে সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ। কারণ, সূর্য উদয়-অস্ত যাওয়ার সময় এবং স্থির মধ্য আকাশে অবস্থানের সময় সালাত আদায় করার দ্বারা যে অনিষ্ট সংঘটিত হয়, কবরের নিকটে সালাত আদায় করা তার চাইতে আরও বেশি বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত, যেহেতু তা শির্ক ও মূর্তিপূজার সাথে অধিক সাদৃশ্য রাখে। যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্যের পথ বন্ধ করার জন্যই উক্ত তিন সময়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন (যে সাদৃশ্যতা সাধারণত মুসল্লীর মনেও উদিত হয় না); সেখানে কবরস্থানে সালাত আদায় কীভাবে বৈধ হতে পারে? অথচ কবরস্থানে সালাত আদায়কারী ব্যক্তি সাধারণত এমন অনেক অপকর্ম ও অপবিশ্বাস লালন করে, যা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ। যেমন: ওলীদেরকে ডাকা, তাদের নিকট প্রয়োজনীয় বস্তু চাওয়া, তাদের কবরের নিকট সালাত আদায় করা এ বিশ্বাসে যে মসজিদে সালাত আদায় করার চেয়ে সেখানে আদায় করা অনেক উত্তম ও ফযিলতপূর্ণ ইত্যাদি।
ইবনুল কায়্যিম র. তাঁর ইগাসাতুল লাহফান গ্রন্থে বলেন: “যে ব্যক্তি কবরের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও আদেশ-নিষেধ এবং সাহাবী ও তাবে‘য়ীগণের নীতিমালাকে আজকের দিনের অধিকাংশ মানুষের নীতিমালার সাথে তুলনা করবে, সে ব্যক্তি দেখতে পাবে যে তার একটি অপরটির বিপরীত, ফলে কখনও উভয়টির সহ-অবস্থান সম্ভব হবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের নিকট সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে সেখানে সালাত আদায় করে; আর তিনি কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে তার উপর মসজিদ নির্মাণ করে ও সেখানে সৌধ নির্মাণ করে; আর তিনি তার উপর বাতি জ্বালাতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর এই কথার বিরোধিতা করে তার উপর প্রদীপ ও মোমবাতি প্রজ্বলিত করে, বরং তারা এটা করার জন্য বিবিধ ধরনের ওয়াকফও করে থাকে।
আর তিনি কবর বাঁধাই করতে ও তার উপর ঘর বানাতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে কবরকে বাঁধাই করে ও তার উপর গম্বুজ প্রতিষ্ঠা করে; আর তিনি কবরের উপর লিখতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে তার উপর ফলক স্থাপন করে ও তার উপর আল-কুরআনের আয়াত ও অন্যান্য বিষয় লিপিবদ্ধ করে; আবার তিনি কবরের উপর তার মাটি ব্যতীত বাড়তি কোনো কিছু ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে কবরের উপর মাটি ব্যতীত ইট, পাথর ও চুনকামের মাধ্যমে স্থাপনা তৈরি করতে চায়। তিনি কবরকে উৎসবস্থল হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন, অথচ তারা তাঁর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধাচরণ করে তাকে উৎসবস্থল হিসেবে গ্রহণ করে, তাকে উদ্দেশ্য করে তারা সমাবেশ ঘটায়, যেমনিভাবে তারা ঈদ-উৎসবকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়, অথবা তার চেয়ে বেশি। মোটকথা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, তারা তার বিরোধিতা করে এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে।
কবর পূজারীদের বিভ্রান্তির প্রসারতা
ঐসব পথভ্রষ্টদের দ্বারা বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, তারা কবরকে হাজ্জের স্থানে (তীর্থস্থানে) পরিণত করল এবং তার জন্য নিয়মনীতি তৈরি করল, এমনকি তাদের মধ্যকার সীমালঙ্ঘনকারীদের কেউ কেউ কবরকে মক্কার সম্মানিত ঘর ‘বাইতুল্লাহর’ সাথে তুলনা করে এ ব্যাপারে গ্রন্থ রচনা করেছে এবং তার নাম দিয়েছে ‘মানাসিকু হাজ্জিল মাশাহেদ’ ( مناسك حج المشاهد ) [পবিত্র স্থানসমূহে হাজ্জের নিয়মনীতি]। আর এ কথা সুস্পষ্ট যে, এটা হলো দীন ইসলাম পরিত্যাগ এবং মূর্তিপূজারীগণের ধর্মে প্রবেশ করা! সুতরাং আপনি তুলনামূলকভাবে লক্ষ্য করুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যে শর‘য়ী বিধান দিয়েছেন তার প্রতি, যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে এবং সেসবের প্রতিও লক্ষ্য করুন, ঐসব ব্যক্তিগণ যেসব নিয়ম প্রণয়ন করেছে আপনি অবশ্যই এতদুভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবেন।
কোনো সন্দেহ নেই যে, এ কবরগুলোকে নিয়ে বাড়াবাড়ির মাধ্যমে এমন সব ফেতনা-ফাসাদের উৎপত্তি হয় যা বর্ণনা করে শেষ করতে মানুষ অপারগ; যেমন:
- কবরের স্থানটিকে সম্মানিত মনে করা, যার ফলে সে তার সাথে ফিতনায় জড়িত হয়ে পড়ে।
- কবরকে মসজিদসমূহের উপর মর্যাদা দেওয়া, অথচ মসজিদ হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থান ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ভূমি। তারা যখন কবরের প্রতি মনোনিবেশ করে, তখন তারা এমন শ্রদ্ধা, সম্মান, বিনয়, নম্রতা, হৃদয়ের কোমলতা ইত্যাদি সহকারে তার প্রতি মনোনিবেশ করে, মসজিদসমূহের ইচ্ছা করলে সেরূপ কিছু বা তার কাছাকাছিও তাদের মধ্যে অর্জিত হয় না।
- কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করা এবং তার উপর প্রদীপ জ্বালানো।
- কবরে অবস্থান করা, তার উপর পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া এবং তার জন্য সেবক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী নিয়োজিত করা, এমনকি তার উপাসকগণ তার নিকটে অবস্থান করাটাকে মসজিদে হারামের নিকট অবস্থান করার উপর প্রধান্য দিয়ে থাকে এবং তারা তার খাদেমদেরকে মসজিদের খাদেমদের চেয়ে মর্যাদাবান মনে করে!
- কবরের উদ্দেশ্যে ও তার খাদেমদের জন্য মানত করা!
- কবরের নিকট সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তা যিয়ারত করা; আর তাকে প্রদক্ষিণ করা, চুম্বন করা, স্পর্শ করা, গালের মধ্যে তার মাটি লাগানো, তার বালি গ্রহণ করা, কবরবাসীকে ডাকা, তাদের মাধ্যমে উদ্ধার কামনা করা, তাদের নিকট সাহায্য-সহযোগিতা, রিযিক, ক্ষমা, সন্তান, ঋণ পরিশোধ, দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা, চিন্তামুক্ত করা ইত্যাদি বিবিধ প্রয়োজন পূরণের জন্য সাহায্য চাওয়া, যা মূর্তিপূজারীগণ তাদের মূর্তিদের নিকট চেয়ে থাকে। অথচ এর কিছুই মুসলিম আলেমদের সর্বসম্মত মতে শরী‘আতসম্মত নয়; কেননা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা, তাবে‘য়ীন ও দীনের সকল ইমামগণের মধ্য থেকে কেউ তা থেকে কোনো কিছু করেননি।
আর এটাও অসম্ভব যে, এগুলো থেকে কোনো কিছু শরী‘য়তসম্মত ও ভাল কাজ বলে গণ্য হওয়া সত্বেও পূর্ববর্তী সোনালী তিন যুগের ঐসব ব্যক্তিবর্গ তার থেকে বিরত থাকবেন যাঁদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষ্য দিয়েছেন, অথচ সেটা পেয়ে ধন্য হবে সেসব পশ্চাতে আগমনকারী ব্যক্তিবর্গ যাদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তাদের মধ্যে মিথ্যা ও পাপাচার বেড়ে যাবে।
সুতরাং এ ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি সন্দেহের মধ্যে থাকলে সে যেন লক্ষ্য করে, যমীনের উপরে বসবাসকারী কারও পক্ষে পূর্বোক্ত সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামদের কোনো একজন থেকেও কি একটি সহীহ অথবা দুর্বল বর্ণনা নিয়ে আসতে পারবে যাতে দেখা যায় যে, যখন তাদের কোনো প্রয়োজন দেখা দিত তখন তারা কবরের প্রতি মনোনিবেশ করে কবরবাসীর নিকট প্রার্থনা করেছেন? তা মাসেহ করেছেন? সেখানে সালাত আদায় করা কিংবা সেগুলোর নিকট তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আবেদন করার মত কিছু তো অনেক দূরের ব্যাপার। কখনও নয়, এ জাতীয় কোনো কিছু তারা কখনও আনয়ন করতে সক্ষম হবে না। অবশ্য তারা পরবর্তী লোকদের থেকে এ ধরনের বহু কাজের দৃষ্টান্ত নিয়ে আসতে পারবে। অতঃপর কাল যত প্রলম্বিত হচ্ছে এবং সময় যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এ জাতীয় গর্হিত কর্মকাণ্ড পরবর্তী লোকদের থেকে ততই বেশি পরিমানে যোগ হচ্ছে। এমনকি (পরবর্তীদের দাবী অনুযায়ী কবরের সাথে বাড়াবাড়ির) এ বিষয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ আমি পেয়েছে যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবী ও তাবে‘য়ীগণের নিকট থেকে একটি বর্ণও বর্ণিত নেই।
বরং এ বিষয়ে তাদের দাবীর বিপরীতে অনেক মারফু‘ হাদিসের বর্ণনা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«كنت نهيتكم عن زيارة القبور فمن أراد أن يزور فليزر ولا تقولوا هجرا» . (أخرجه أحمد والنسائي بتمامه).
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং যে ব্যক্তি (বর্তমানে) কবর যিয়ারত করতে চায়, সে যেন যিয়ারত করে এবং তোমরা খারাপ (বাজে) কথা বলবে না।”[7]
আর কবরের নিকট শির্কের চেয়ে বড় ধরনের বাজে কথা ও কাজ কোনটি!
আর সাহাবীদের নিকট থেকে আগত বর্ণনার সংখ্যা অনেক, যা গণনায় সীমাবদ্ধ করাটা দূরূহ ব্যাপার, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে: ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে কোনো এক কবরের নিকট সালাত আদায় করতে দেখে বললেন, কবর! কবর[8]! ইবনুল কায়্যিম র. তার ‘আল-ইগাসা’ গ্রন্থে বলেন: “এটা প্রমাণ করে যে, সাহাবীদের নিকট এটা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল যে, কবরের কাছে সালাত আদায় করা যায় না। কারণ তাদের নবী তাদেরকে কবরের নিকট সালাত আদায় করা থেকে নিষেধ করেছেন; আর আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র কাজ প্রমাণ করে না যে, তিনি কবরের নিকট সালাত আদায় করাকে বৈধ বলে বিশ্বাস করতেন; কারণ, হতে পারে তিনি তা দেখেননি অথবা তিনি জানতেন না যে, তা কবর, অতঃপর যখন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে সতর্ক করলেন, তখন তিনি সতর্ক হয়ে গেছেন।
- কবর কেন্দ্রিক ফেতনা-ফাসাদের অন্যতম একটি বড় ফেতনা হচ্ছে, কবরকে উৎসবের স্থানে পরিণত করা, যেমনিভাবে আহলে কিতাবদের মুশরিকগোষ্ঠী তাদের নবী ও সৎব্যক্তিদের কবরসমূহকে উৎসবের স্থানে পরিণত করেছে! কেননা তারা তাদের কবরসমূহ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হত এবং তারা সেখানে খেল-তামাশা ও আনন্দ-উল্লাস, গান-বাদ্যে মগ্ন থাকত; তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এর থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لاَ تَجْعَلُوا قَبْرِى عِيدًا وَصَلُّوا عَلَىَّ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ تَبْلُغُنِى حَيْثُ كُنْتُمْ » . (أخرجه أبو داود) .
“তোমরা আমার কবরকে উৎসবের জায়গায় পরিণত করো না; আর তোমরা আমার উপর দুরূদ পাঠ কর; কেননা তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পৌঁছানো হয়ে থাকে।”[9]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যমীনের উপরে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কবর হওয়া সত্ত্বেও যখন তাকে উৎসবের জায়গায় পরিণত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, তখন অন্যের কবরকে উৎসবের জায়গায় পরিণত করা নিষিদ্ধ হওয়া আরও বেশি যুক্তিযু্ক্ত। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাণী “তোমরা আমার উপর সালাত (দুরূদ) পাঠ কর; কারণ, তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমাদের সালাত আামার নিকটে পৌঁছানো হয়” এর দ্বারা ইঙ্গিত করেছেন যে, তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে যে কেউ তাঁর নিকট সালাত ও সালাম (দুরূদ) পাঠানোর ইচ্ছা পোষণ করে, তাঁর কবর থেকে তাদের অবস্থান নিকটে ও দূরে হওয়া সত্ত্বেও তার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে; সুতরাং তাদের জন্য তার কবরকে উৎসবের জায়গায় পরিণত করার কোনো প্রয়োজন নেই; কেননা কবরকে উৎসবের জায়গায় পরিণত করার মধ্যে এমন অনেক ফেতনা ও সমস্যা রয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। কারণ; যারা কবরকে ঈদ বা উৎসবস্থল বানায় তাদের মধ্যে সীমালঙ্গনকারীদের দেখা যায় যে তারা যখন তাকে দূরবর্তী স্থান থেকে দেখে, তখন তারা তাদের বাহন থেকে নেমে পড়ে, তাদের মাথাসমূহ উন্মুক্ত করে, তাদের কপালসমূহ যমীনের উপর রাখে এবং যমীনকে চুম্বন করে, অতঃপর তারা যখন সমাধিস্থলে পৌঁছে, তখন তারা তার নিকটে দুই রাকাত সালাত আদায় করে; অতঃপর তারা সম্মানিত কা‘বা ঘর -যাকে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির জন্য বরকত ও হিদায়াতের কেন্দ্র বানিয়েছেন- তাকে তাওয়াফ করার মত সে কবরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাকে প্রদক্ষিণ করে করে থাকে। অতঃপর তারা তাকে এমনভাবে চুম্বন ও স্পর্শ করতে শুরু করে, যেমনটি হাজীগণ মসজিদে হারামে করে থাকে। অতঃপর তারা তাদের কপালে ও গালে মাটি মেখে নেয়, অতঃপর তারা মাথা মুণ্ডন অথবা মাথার চুল কাটার মাধ্যমে কবরের হজ্জের যাবতীয় কাজের পরিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটায়। অতঃপর তারা সেই কবর নামক মূর্তির জন্য কুরবানী পেশ করে। তাদের সালাতসমূহ, যাবতীয় উপাসনা, কুরবানী, বিসর্জিত অশ্রু, উচ্চ আহ্বান, প্রয়োজন পূরণের আবেদন, দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও অভাবীদেরকে অভাবমুক্ত করার জন্য এবং রোগাক্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিষ্কৃতি দানের জন্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি কোনোটিই আল্লাহ তা‘আলা’র জন্য নিবেদিত হয় না, বরং তা নিবেদিত হয় শয়তানের জন্য। কারণ শয়তান হচ্ছে আদম সন্তানদের জন্য প্রকাশ্য শত্রু, সে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে চলা থেকে বাধা প্রদান করে।
বস্তুত শয়তানের ষড়যন্ত্রের অন্যতম বড় ফাঁদ হলো, মূর্তিপূজার বেদীসমূহ থেকে মানুষের জন্য কোনো বেদী স্থাপন করা[10], যা অপবিত্র-ঘৃণিত, শয়তানী কর্মকাণ্ডের শামিল; আর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে তা বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এই বর্জন করার সাথে তাদের সফলতাকে শর্তযুক্ত করেছেন; তিনি বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ ﴾ [المائدة: ٩٠]
“হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয় করার শর তো কেবল অপবিত্র-ঘৃণিত বস্তু, শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা সেগুলো বর্জন কর- যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”[11]
আয়াতে বর্ণিত " الأنصاب " শব্দটি " نُصُب "(প্রথম দুই বর্ণে পেশসহ) শব্দের বহুবচন, অথবা " نَصْب "(প্রথম বর্ণে যবর ও দ্বিতীয় বর্ণে সাকিনসহ) শব্দের বহুবচন, আর তা হল এমন প্রতিটি বস্তু, আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যার পূজা ও উপাসনা করা হয়, যেমন: গাছপালা অথবা পাথর অথবা কবর অথবা এগুলো ব্যতীত অন্য কিছু। তাই এসব কিছুকে ধ্বংস করে ফেলা এবং তার চিহ্ন মুছে ফেলা ফরয[12], যেমনভিাবে ওমর র. নিকট যখন সংবাদ পৌঁছল যে, লোকজন ঐ গাছটিকে (বরকত হিসেবে) গ্রহণ করছে, যার নীচে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে বাই‘আত (শপথ) অনুষ্ঠান করেছেন, তখন তিনি ঐ গাছের নিকট লোক পাঠালেন, অতঃপর তা কেটে ফেলা হয়।[13] সুতরাং ওমর রা. যখন সে গাছটির সাথে এ আচরণ করেছিলেন, যার নীচে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন এবং যার আলোচনা আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মধ্যে করেছেন, যেমন তিনি বলেন:
﴿ لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ ... ﴾ [الفتح: ١٨]
“অবশ্যই আল্লাহ মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নীচে আপনার কাছে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল, ...।”[14]
তাহলে এসব (কবর নামক) মূর্তি বা উপাসনার বেদীসমূহের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে, যেগুলোর ফিতনা বড় আকার ধারণ করে এবং যার কারণে ঈমান বিপর্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়।
আর এর চেয়ে আরও উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে দিরারকে (ক্ষতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদ) ধ্বংস করে দিয়েছিলেন[15]; যা প্রমাণ করে যে, মসজিদে দ্বিরার থেকেও বেশি ও বড় ফিতনা ফাসাদের বস্তু বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী জিনিস ধ্বংস করা আবশ্যক; যেমন কবরের উপর নির্মিত মসজিদসমূহ, কারণ-
কবরের উপর নির্মিত মসজিদসমূহের ব্যাপরে ইসলামের বিধান
কবরের উপর নির্মিত মসজিদসমূহের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হল, এই ধরনের সব মসজিদকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে, এমনকি তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে; আর অনুরূপভাবে ঐসব গম্বুজগুলোকেও ধ্বংস করা ফরয, যেগুলো কবরের উপর নির্মিত হয়েছে; কারণ, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবধ্যতা ও তাঁর বিরোধিতার উপর; আর এমন প্রত্যেক স্থাপত্য যা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবধ্যতা ও তাঁর বিরোধিতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা ধ্বংস করা মসজিদে দিরার (ক্ষতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদ) ধ্বংস করার চেয়ে উত্তম কাজ। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর স্থাপত্য নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন এবং তার উপর মসজিদ নির্মাণকারীদেরকে লা‘নত (অভিশাপ) করেছেন; সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা থেকে নিষেধ করেছেন এবং যা বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিকে লা‘নত করেছেন, তা দ্রুত ও তাড়াতাড়ি ধ্বংস করা ফরয। আর এ জন্যই কবরের উপর প্রজ্জ্বলিত প্রতিটি মোমবাতি ও প্রদীপ অপসারণ করা ফরয; কারণ, এ কাজ বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিশাপ দ্বারা অভিশপ্ত; আর যে কাজের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা‘নত করেছেন, তা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
এ জন্যই আলেমগণ বলেছেন: কবরের উদ্দেশ্যে মোমবাতি, তেল ইত্যাদি কোনো কিছুই মানত করা জায়েয হবে না; কারণ, তা অবাধ্যতাপূর্ণ মানত, এটা পূর্ণ করা বৈধ নয়, বরং তাতে শপথের কাফফারার ন্যায় কাফফারা আবশ্যক হবে। অনুরূপভাবে কবরের জন্য কোনো কিছু ওয়াকফ করাও বৈধ নয়; কারণ, এই ওয়াকফ শুদ্ধ হবে না এবং তা বলবৎ রাখা ও বাস্তবায়ন করা বৈধ হবে না। ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের উপর রহম করুন! আপনারা লক্ষ্য করুন, যেখানেই আপনারা এমন কোনো গাছ দেখতে পাবেন, যাকে জনগণ বিশেষ উপলক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তার কাছে তারা মুক্তি ও আরোগ্য কামনা করে এবং তাতে পেরেক ও কাপড় লটকায় তা-ই শরীয়ত নিষিদ্ধ লটকানোর স্থানে পরিণত হয়, সুতরাং তা আপনারা কেটে ফেলবেন। আর “লটকানোর স্থান” এর কাহিনী হচ্ছে, আরবের মুশরিকদের একটি লটকিয়ে রাখার গাছ ছিল, তারা তাতে তাদের অস্ত্রসস্ত্র ও রসদপত্র লটকিয়ে রাখত এবং তারা তার চতুষ্পার্শ ঘিরে বসত। যেমনটি ইমাম তিরমিযী র. তাঁর ‘আস-সুনান’ গ্রন্থে আবূ ওয়াকিদ আল-লাইসী রা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন:
« خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم قبل حنين و نحن حديثو عهد بالإسلام, و للمشركين سدرة يعكفون حولها و ينوطون بها أسلحتهم و أمتعتهم, يقال لها ذات أنواط, فقلنا يا رسول الله: اجعل لنا ذات أنواط كما لهم ذات أنواط . فقال النبي صلى الله عليه و سلم: الله أكبر إنها السنن قلتم و الذي نفسي بيده كما قالت بنو إسرائيل لموسى ﴿ ٱجۡعَل لَّنَآ إِلَٰهٗا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةٞۚ قَالَ إِنَّكُمۡ قَوۡمٞ تَجۡهَلُونَ ١٣٨ ﴾ [الاعراف: ١٣٨] إنكم لتركبن سنن من كان قبلكم » .
“আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইনের যুদ্ধের পূর্বে বের হলাম; তখন আমরা ছিলাম নওমুসলিম; আর মুশরিকদের একটা বরই গাছ ছিল, তারা তার চতুষ্পার্শ ঘিরে বসত এবং তারা তাদের হাতিয়ার ও রসদপত্র তাতে লটকিয়ে রাখত; তাকে “লটকানোর গাছ” বলা হত; অতঃপর আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও “লটকানোর গাছ” নির্ধারিত করে দিন যেমনটি নির্ধারিত রয়েছে তাদের জন্য। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “আল্লাহু আকবার! নিশ্চয় এটা স্বীকৃত নিয়মনীতি; ঐ সত্বার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমরা তো এমন কথাই বলছ, যেমন বনী ইসরাইল মূসাকে বলেছিলঃ (তাদের যেমন অনেক উপাস্য রয়েছে আমাদের জন্যও তেমন উপাস্য নির্ধারিত করে দিন; তিনি বললেন: তোমরা তো এক জাহিল সম্প্রদায়।)[16]
অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে’।”[17] দেখা যাচ্ছে যে, গাছটিকে হাতিয়ার লটকিয়ে রাখা ও তার চতুষ্পার্শ্ব ঘিরে বসার জন্য গ্রহণ করাকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অপর ইলাহ গ্রহণ করা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, অথচ তারা এর উপাসনাও করে না এবং এর নিকট কোনো কিছু প্রার্থনাও করে না। তাহলে মানুষ যেসব গাছপালা, পাথর অথবা কবরকে উদ্দেশ্য করে, সম্মান করে, রোগমুক্তি কামনা করে, আর বলে যে এ গাছ-পাথর বা কবর মানত গ্রহণ করে (যে মানত মূলত একটি ইবাদত ও নৈকট্য), আর এসব বেদি মাসেহ করে এবং তা স্পর্শ করে— সেগুলোর ব্যাপারে কীরূপ ধারণা করা সঙ্গত![18]
যে মাকামে ইবরাহীমকে আল্লাহ তা‘আলা মুসাল্লা বা সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন, সালাফে সালেহীন তথা পূর্ববর্তী সত্যনিষ্ঠ আলেমগণ সেটাকে স্পর্শ করতে নিষেধ করতেন, যেমনটি ইমাম আযরাকী আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ ﴾ [البقرة: ١٢٥]
[তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর][19] এর তাফসীরে কাতাদা রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাকামে ইবরাহীমের নিকট সালাত আদায় করতে, তাদেরকে তা স্পর্শ করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি; বরং আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন যে, তাকে স্পর্শ ও চুম্বন করা যাবে না, তবে হাজরে আসওয়াদের বিষয়টি ভিন্ন।
আর রুকনে ইয়ামানী’র ব্যাপারে বিশুদ্ধ মত হল, তাকে স্পর্শ করা যাবে, কিন্তু চুম্বন করা যাবে না। অথচ এ শয়তান সর্বকালে ও সর্বসময়ে সম্মানিত ব্যক্তির কবরকে বেদী হিসেবে পেশ করে, ফলে মানুষজন তাকে সম্মান করে; অতঃপর সে তাকে এমন প্রতিমা বা মূর্তিতে পরিণত করে, আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে যার উপাসনা করা হয়; অতঃপর সে তার বন্ধু-বান্ধবদের নিকট নির্দেশনা প্রেরণ করে যে, যে ব্যক্তি তার উপাসনা থেকে নিষেধ করে, তাকে উৎসবের স্থলে পরিণত করতে বারণ করে এবং তাকে প্রতিমা হিসেবে নির্দিষ্টকরণে বাধা প্রদান করে, সে ব্যক্তি তো এর অসম্মান-অপমান করছে এবং তার অধিকার নষ্ট করছে— ফলে মূর্খ ব্যক্তিরা তাকে হত্যা করা ও শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টাসাধনা করে এবং তারা তাকে কাফির বলে ফতোয়া দেয়। অথচ তার অপরাধ তো শুধু এই যে, সে তাদেরকে তাই আদেশ করে, যা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল আদেশ করেছেন এবং শুধু তা থেকে নিষেধ করে, যা থেকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন।
[কবরপূজায় জড়িয়ে পড়ার পেছনে মূল কারণসমূহ]
কবর পূজারীরা এ কবর পূজার মত ফেতনায় জড়িয়ে পড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
- আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে তাওহীদ তথা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা ও শির্কের সকল উপায়-উপকরণ মুলোৎপাটন করার যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতা। সুতরাং যাদের মধ্যে এ জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে, তাদেরকে যখন শয়তান এ কবর পূজার মত ফিতনার দিকে আহ্বান করে এবং তাদের নিকট এমন কোনো জ্ঞানগত পুঁজি না থাকে যা দ্বারা তারা শয়তানের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, তখন তারা তাদের নিকট বিদ্যমান মূর্খতা ও অজ্ঞতার অনুসারে তার আহ্বানে সাড়া দেয় এবং তাদের সাথে থাকা জ্ঞান পরিমাণ তার থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
- কতগুলো লিখিত হাদিস, যেগুলো কবরের মত মূর্তিপূজারীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করে রচনা করেছে; বস্তুত এ হাদিসগুলো তিনি যে দীন নিয়ে এসেছেন, তার সম্পূর্ণ বিরোধী; তেমন একটি (বানোয়াট) হাদিস:
« إذا تحيرتم في الأمور فاستعينوا بأهل القبور » .
“যখন তোমরা কোন কাজের ক্ষেত্রে দিশেহারা হয়ে যাবে, তখন তোমরা কবরবাসীদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করবে।”[20] অপর আরেকটি (বানোয়াট) হাদিস:
«إذا أعيتكم الأمور فعليكم بأصحاب القبور» .
“যখন কাজকর্ম তোমাদেরকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে, তখন তোমাদের উপর আবশ্যক হল কবরবাসীদের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা।”[21] অপর আরেকটি (বানোয়াট) হাদিস:
« لو حسن أحدكم ظنَّه بحجر نفعه » .
“যদি পাথরের প্রতি তোমাদের কারও ধারণা ভাল হয়, তবে সেই পাথর তার উপকার করবে।”[22] এই হাদিসগুলোর মত আরও বহু (বানোয়াট) হাদিস রয়েছে, যেগুলো দীন ইসলামের বিরোধী ও বিপরীত, যা কবরের মত মূর্তিপূজারীগণ তৈরি করেছে এবং যেগুলো অজ্ঞ ও পথভ্রষ্টদের মাঝে চালু রয়েছে; আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হল, তিনি লড়াই করবেন ঐ ব্যক্তির সাথে, যে পাথর ও বৃক্ষরাজির প্রতি (এ জাতীয়) সুধারণা পোষণ করে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে কবরের দ্বারা ফিতনায় নিপতিত হওয়ার সকল পথ থেকে দূরে রেখেছেন।
- কবরবাসী প্রসঙ্গে বর্ণিত কাহিনীসমূহ; যেমন- অমুক ব্যক্তি কঠিন বিপদের সময় অমুক ব্যক্তির কবরের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করেছে, অতঃপর সে তা থেকে মুক্তি পেয়েছে। অমুক ব্যক্তির উপর বিপদ নাযিল হলো, অতঃপর এই কবরবাসীর নিকট আবেদন করল, ফলে তার ক্ষতিকর বিষয়টি দূর হয়ে গেল; অমুক ব্যক্তি কোনো এক প্রয়োজনে তাকে ডেকেছে, অতঃপর তার প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেছে। মূলত এসব কবরের খাদেম ও কবরপূজারীদের নিকট এ ধরণের হাজারও কাহিনী রয়েছে, যার আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে।
বস্তুত আল্লাহর সৃষ্টজীবের মধ্যে এরা জীবিত ও মৃতদের উপর সবচেয়ে বড় মিথ্যারোপকারী। আর প্রাণী মাত্রই যখন তার প্রয়োজন পূরণ ও তার জন্য ক্ষতিকারক বস্তু দূর করার ব্যাপারে আসক্ত ও অনুরক্ত থাকে, বিশেষ করে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে যায়, তখন সে যে কোনো উপায়-উপকরণ গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। যদিও তাতে কোনো ধরনের অপছন্দনীয় বিষয় জড়িয়ে থাকুক। সুতরাং কেউ যখন শুনে যে, অমুকের কবর বিষের পরীক্ষিত প্রতিষেধক ঔষধ, সে তখন ঐ দিকে ধাবিত হয়, অতঃপর সে সেখানে যায় এবং তার নিকট মনের যাতনা, বিনয়-নম্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করার মাধ্যমে দো‘আ করে, অতঃপর তার মনে বিনয়-নম্রতা ও অক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তার দো‘আ কবুল করেন। মূলত এটা কবরের কারণে নয়; কারণ সে যদি অনুরূপ দো‘আ ক্লাব-বার, গোসলখানা কিংবা বাজারের মধ্যেও করত, তাহলেও তিনি তা কবুল করতেন। সুতরাং জাহিল তথা অজ্ঞ ব্যক্তি ধারণা করে যে, এই দো‘আ কবুল করার ক্ষেত্রে কবরের প্রভাব রয়েছে; অথচ সে জানে না যে, আল্লাহ তা‘আলা নিরুপায় ব্যক্তির দো‘আ কবুল করে থাকেন, যদিও সে কাফির হয়।
তাছাড়া বিষয়টি এমন নয় যে, প্রত্যেক এমন ব্যক্তি, যার দো‘আ আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেছেন, তিনি তার প্রতি সন্তুষ্ট বা তিনি তাকে ভালবাসেন কিংবা তার কর্মকাণ্ডের প্রতি সন্তুষ্ট; কারণ, তিনি পুণ্যবান ব্যক্তি ও পাপী উভয়ের দো‘আই কবুল করে থাকেন; অনুরূপভাবে দো‘আ কবুল করেন মুমিন ও কাফিরের।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দয়া ও করুনায় আমাদের জন্য এমন দো‘আ ও আমলকে সহজ করে দিন, যা তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী হবে।
* * *
[1] বুখারী (৭/৭৪৭), হাদিস নং- ৪৪৪৩, অধ্যায়: মাগাযী (كتاب المغازي), পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতা ও তাঁর মৃত্যু (باب مرض النبي صلى الله عليه و سلم ووفاته); মুসলিম (১/৩৭৭), হাদিস নং- ৫৩১, অধ্যায়: মাসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহ (المساجد و مواضع الصلاة) পরিচ্ছেদ: কবরের উপর মাসজিদ নির্মাণ, মাসজিদে ছবি বানানো ও কবরকে সিজদার স্থান করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে (باب النَّهْىِ عَنْ بِنَاءِ الْمَسَاجِدِ عَلَى الْقُبُورِ وَاتِّخَاذِ الصُّوَرِ فِيهَا وَالنَّهْىِ عَنِ اتِّخَاذِ الْقُبُورِ مَسَاجِدَ) । তাঁরা উভয়ে আয়েশা রা. থেকে উবায়দুল্লাহ ইবন আবদিল্লাহ ও আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিস থেকে মারফু‘ সনদে বর্ণনা করেছেন।
[2] আহমদ (২/২৪৬) মারফু‘ সনদে সুহাইল ইবন আবি সালেহ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি তার পিতা থেকে, তার পিতা আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তবে মুসনাদে আহমদে "يعبد" কথাটি নেই; মালেক (১/১৭২), হাদিস নং- ৮৫, অধ্যায়: কসরের সালাত প্রসঙ্গে (في قصر الصلاة), পরিচ্ছেদ: জামে‘উস সালাত (باب جامع الصلاة), তিনি ‘আতা ইবন ইয়াসার থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন; আবদুর রাযযাক (৮/৪৬৪), হাদিস নং- ১৫৯১৬, তিনি সাফওয়ান ইবন সুলাইম এবং সা‘ঈদ ইবন আবি সা‘ঈদ মাওলা আল-মাহরী’র সনদে মারফু‘ এবং মুরসাল সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
[3] মুসলিম (১/৩৭৭), হাদিস নং- ৫৩১, অধ্যায়: মাসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহ (المساجد و مواضع الصلاة), পরিচ্ছেদ: কবরের উপর মাসজিদ নির্মাণ, মাসজিদে ছবি বানানো ও কবরকে সিজদার স্থান করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে (باب النَّهْىِ عَنْ بِنَاءِ الْمَسَاجِدِ عَلَى الْقُبُورِ وَاتِّخَاذِ الصُّوَرِ فِيهَا وَالنَّهْىِ عَنِ اتِّخَاذِ الْقُبُورِ مَسَاجِدَ), তিনি আবদুল্লাহ ইবনিল হারেস আন-নাজরানী থেকে পরিপূর্ণভাবে মারফু‘ সনদে হাদিসখানা বর্ণনা করেছেন, তিনি জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন। আর ইবনু সা‘য়াদ বর্ণনা করেছেন ‘আত-তাবাকাত’ –এর মধ্যে, তার প্রথম কথা হল: « إِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ»।
[4] সূরা নূহ, আয়াত: ২১ - ২৩
[5] বুখারী (৮/৫৩৫), হাদিস নং- ৪৯২০, তাফসীর অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: (ওয়াদ্, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ ও ইয়া‘ঊক) প্রসঙ্গে (باب " وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ "), হাদিসটি ‘আতা র. সূত্রে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত।
[6] যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: « الأرض كلها مسجد الا المقبرة والحمام» (কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত সমস্ত পৃথিবীই মাসজিদের মত সালাত আদায়ের স্থান)। - আহমদ (৩/৮৩, ৯৬); আবূ দাউদ (১/৩৩০), হাদিস নং- ৪৯২, সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যেসব স্থানে সালাত আদায় অবৈধ (باب في المواضع التي لا تجوز فيها الصلاة); তিরমিযী (২/১৩১), সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত গোটা পৃথিবীই মাসজিদ হওয়া প্রসঙ্গে বর্ণনা (باب ما جاء أن الأرض كلها مسجد الا المقبرة والحمام) এবং তিনি বলেছেন: এই হাদিসটির মধ্যে গোলমাল রয়েছে; ইবনু মাজাহ (১/২৪৬), হাদিস নং- ৭৪৫, অধ্যায়: মাসজিদ ও জামায়াত (كتاب المساجد و الجماعات), পরিচ্ছেদ: যেসব স্থানে সালাত আদায় করা মাকরূহ (باب المواضع التي تكره فيها الصلاة); ইবনু হাব্বান (৩/১০৩) হাদিস নং- ১৬৯৭, (৪/৩২) হাদিস নং- ২৩১২, (৪/৩৩) হাদিস নং- ২৩১৬ (ইহসান); হাকেম (১/২৫১) এবং তিনি এই সনদগুলো বর্ণনা করার পর বলেন: সবগুলো সনদই ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. –এর শর্ত অনুযায়ী সহীহ, তবে তাঁরা হাদিসটি তাঁদের গ্রন্থে বর্ণনা করেননি; আর ইমাম যাহাবী র.ও অনুরূপ কথাই বলেছেন; তারা সকলেই মারফু‘ সনদে ‘আমর ইবন ইয়াহইয়া আল-আনসারী’র সূত্রে তার পিতা থেকে, তিনি আবূ সা‘ঈদ রা. থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
[7] আহমদ (৩/৩৮) মারফু‘ সনদে মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া ইবন হাব্বান থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেন, তিনি তার চাচা থেকে, তার চাচা আবূ সা‘য়ীদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তার শব্দগুলো হল: « إِنِّي نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا فَإِنَّ فِيهَا عِبْرَةً» (আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং তোমরা তা যিয়ারত কর; কারণ, তাতে শিক্ষা বা উপদেশ রয়েছে)। হাইসামী র. ‘আল-মাজমা‘’ [ المجمع ] (৩/৫৭) গ্রন্থের মধ্যে বলেন: ইমাম আহমদ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেছেন, তার বর্ণনাকারী ব্যক্তিগণ সকলেই বিশুদ্ধ হাদিসের বর্ণনাকারী। আর ইমাম নাসায়ী র. (৪/৮৯) জানাযা অধ্যায়ের ‘কবর যিয়ারতের পরিচ্ছেদে (باب زِيَارَةِ الْقُبُورِ) মারফু‘ সনদে (ইবনু বুরাইদা থেকে, তিনি তার পিতা থেকে) হাদিসখানা সম্পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন।
[8] বুখারী, অধ্যায়: মাসজিদ (أبواب المساجد), পরিচ্ছেদ: জাহেলী যুগের মুশরিকদের কবর খুঁড়ে ফেলে তদস্থলে মাসজিদ নির্মাণ করা প্রসঙ্গে (باب هل تنبش قبور مشركي الجاهلية ويتخذ مكانها مساجد), তা‘লীক।
[9] আবূ দাউদ (২/৫৩৪), হাদিস নং- ২০৪২, অধ্যায়: হজ্জের কাজসমূহ (كتاب المناسك), পরিচ্ছেদ: কবর যিয়ারত প্রসঙ্গে (باب زِيَارَةِ الْقُبُورِ), হাদিসটি সা‘ঈদ ইবন আবি সা‘ঈদ আল-মাকবেরী আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; আলবানী ‘সহীহ আল-জামে‘ আস-সাগীর’ [ صحيح الجامع الصغير ] (২/১২১১), হাদিস নং- ৭২২৬
[10] কবরপূজা করাটা দেব-দেবী ও মূর্তিপূজারীদের কাজ বলে প্রমাণিত; কারণ, যখন কবরের উপাসনা করা হয়, তখন তা প্রতিমা ও মূর্তি হয়ে যায়।
[11] সূরা আল-মায়িদাহ্, আয়াত: ৯০
[12] এর মধ্যে ঐসব কবরগুলো ধ্বংস করা ফরয হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে, যেগুলোর উপাসনা বা পূজা করা হয় এবং ঐসব কবরের উপর যা নির্মাণ করা হয়েছে, তাও ধ্বংস করা ফরয।
[13] ঘটনাটি ইবনু সা‘দ তার ‘আত-তাবাকাত’ (الطبقات) –এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন, ২/১০০; আর ইমাম মুহাম্মদ ইবন ওয়াদ্দাহ ‘আল-বিদা‘উ’ ওয়ান নাহইয়ু ‘আনহা’ (البدع و النهي عنها) নামক গ্রন্থের মধ্যে তা বর্ণনা করেছেন: ৪২ – ৪৩; ইবনু আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ: ২/৩৭৫; আর হাফেজ ইবনু হাজার ‘আসকালানী র. (৭/৪৪৮) সনদটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।
[14] সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ১৮
[15] দেখুন: সীরাতু ইবনে হিশাম (২/৫২৯, ৫৩০)।
[16] সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ১৩৮
[17] তিরমিযী (৪/৪৭৫), হাদিস নং- ২১৮০, অধ্যায়: ফিতনা (كتاب الفتن), পরিচ্ছেদ: অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে (باب ما جاء لتركبن سنن من كان قبلكم); আর ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদিসটি হাসান, সহীহ। আহমদ (৫/২১৮); আবদুর রায্যাক (১১/৩৬৯), হাদিস নং- ২০৭৬৩, পরিচ্ছেদ: তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি প্রসঙ্গে (باب سنن من كان قبلكم); তাবারানী, আল-কাবীর (৩/৩২৯০, ৩২৯১, ৩২৯২, ৩২৯৩, ৩২৯৪); ইবনু হাব্বান, আস-সহীহ (৮/২৪৮), হাদিস নং- ৬৬৬৭, পরিচ্ছেদ: এই উম্মত কর্তৃক তাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের রীতিনীতি অনুসরণ সম্পর্কিত হাদিসসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে (باب ذكر الأخبار عن اتباع هذه الأمة سنن من قبلهم من الأمم); আত-তায়ালাসী (১৩৪৬); আবূ ই‘য়ালা বর্ণনা করেন তার মুসনাদে (২/১৫৯), হাদিস নং- ১৪৩৭; হুমাইদী বর্ণনা করেন তার মুসনাদে (২/৩৭৫), হাদিস নং- ৮৪৮; ইবনু জারীর, আত-তাফসীর (৯/৪৫), নাসায়ী, আত-তাফসীর (পৃ. ৭৬); আলকায়ী, শরহু উসূললি ই‘তিকাদ [ شرح أصول الاعتقاد ] (১ /১২৪), হাদিস নং- ৫০৪, ২০৫; ইবনু আবি ‘আসেম, আস-সুন্নাহ (১/৩৭), হাদিস নং- ৭৬; ইবনু আবি শায়বা, ইবনুল মুনযের, ইবনু আবি হাতেম, আবু শাইখ ও ইবনু মারদুইয়াহ প্রমূখ বর্ণনা করেন, যেমনটি রয়েছে আদ-দুররুল মানছূর (الدر المنثور) গ্রন্থে (৩/১১৪)। তাঁদের সকলেই সিনান ইবন আবি সিনান থেকে সনদ পরস্পরায় আবূ ওয়াকিদ আল-লাইসী থেকে মারফু‘ সনদে বর্ণনা করেছেন; আর এই হাদিসটি বিশুদ্ধ।
[18] অর্থাৎ তা অবশ্যই শির্ক হিসেবে গণ্য হবে এবং আল্লাহ ব্যতীত এগুলোর ইবাদাত হিসেবে ধর্তব্য হবে। [সম্পাদক]
[19] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫
[20] ‘আজলূনী, কাশফুল খাফা (كشف الخفاء): ১/৮৫
[21] শাইখুল ইসলাম বলেন: “এই হাদিসটি হাদিস বিশারদগণ ও আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আরোপিত মিথ্যা অপবাদ এবং নির্ভরযোগ্য হাদিসের গ্রন্থসমূহে এ ধরনের কিছুই পাওয়া যায় না”। দেখুন: আত-তাওয়াসসুল ওয়াল অসিলা (التوسل والوسيلة), পৃ. ২৯৭ এবং আর-রাদ্দু ‘আলাল বিকরী (الرد على البكري), পৃ. ৩০২ - ৩০৩
[22] ‘তামঈযুত তায়্যিব মিনাল খাবীস’ (تمييز الطيب من الخبيث) এর ১৩৩ পৃষ্ঠায় এ হাদিসটি বর্ণনার পর বলা হয়েছে: ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা বলেন: নিশ্চয়ই হাদিসটি মিথ্যা ও বানোয়াট; আর ইবনু হাজার ‘আসকালানী র. বলেন: এর কোনো ভিত্তি নেই।